অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়: সালটা সম্ভবত ১৯৮৬-৮৭। ব্যান্ডেলে নবাঙ্কুর সংঘের ৫০ বছর উদযাপন। কী হবে, কী হবে চলছে গোটা ব্যান্ডেল জুড়ে। সময়টা অনেক বেশি খাঁটি ছিল বোধহয় সব অর্থে। মানুষের মধ্যে মেলামেশা ছিল, একে অপরের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া ছিল, পাড়ার বড়দের শাসন ছিল, ক্লাব ছিল, মাঠ ছিল, মাঠ ভর্তি ছেলে ছিল, আর কিছু সিনিয়র দাদা ছিল, যাঁদের দেখে মনে হত, ইস যদি এর মত হতে পারতাম। ব্যান্ডেলে সেই সময়টা আমাদের প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে যেত মিঠুদা। মিঠু পোষাকি নাম, আসল নাম অভিজিৎ বিশ্বাস।
ওই সময়টা গোটা ব্যান্ডেল বিশ্বাস করত, ফুটবল খেলে আমাদের এলাকাকে নতুন পরিচিতি এনে দেবে মিঠু। আসলে একজন সফল মানুষ গোটা এলাকাকে বিখ্যাত করে দিতে পারে। বাইচুং-এর সাফল্য তিনকিতামকে বিখ্যাত করে দিয়েছে, সুব্রত ভট্টাচার্য বললে আমরা শ্যামনগরকেই বুঝি, সেহবাগ বিখ্যাত করে দিয়েছেন নজফগড়কে, শিশির ঘোষ, সুধীর কর্মকার বললে যে কোন বাঙালি ফুটবলপ্রেমী রিষড়াকেই চেনে। ব্যান্ডেল তখন বিখ্যাত সুরজিৎ সেনগুপ্তর নামে। ছোট থেকে কত কথা শুনতাম সুরজিৎ সেনগুপ্তকে নিয়ে। ওঁর ভাইও যদি ব্যান্ডেল রেলের মাঠে খেলতে আসত, তাকে দেখার জন্য মাঠে উপচে পড়ত মানুষ। পরবর্তীকালে ব্যান্ডেল থেকে বড় ক্লাব খেললেন সত্যজিত ঘোষ। সত্যজিৎদা থাকতেন ব্যান্ডেলের পাশেই দেবানন্দপুরে। এরাই তখন আমাদের লোকাল হিরো। আর সবাই অপেক্ষা করেছিলাম মিঠুদার জন্য।
সাইড ব্যাকে খেলত। অসাধারণ ফুটবল স্কিল, আর সঙ্গে অসম্ভব উপস্থিত বুদ্ধি। যখন স্কুল লেভেলে পড়াশোনা করছে, তখনই ওকে খেলতে নিয়ে চলে গেছে চুঁচুড়ার বেঙ্গল ক্লাব। সাব ডিভিশন লিগে বেঙ্গল তখন নামি ক্লাব। সেখানে জেলার সেরা ফুটবলাররা খেলে। আর তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রথম টিমে খেলে যাচ্ছিল মিঠুদাও। নবাঙ্কুরের ৫০ বছর উদযাপনটা হল বেশ ঘটা করে। সকালে পদযাত্রায় দেখলাম এক ঝাঁক ফুটবলারকে। বিকেলে আমাদের ব্যান্ডেল বিদ্যামন্দির স্কুলের মাঠে তো চাঁদের হাট, কে নেই সেখানে। সুব্রত, গৌতম, প্রসূন, পিকে ব্যানার্জির সাথে আরও বহু নাম। একটা ম্যাচে কলকাতা একাদশ খেলল, তাঁর বিপক্ষে হুগলি জেলা একাদশ। হুগলি টিমেও তখন সেরারা। স্বপন সাহা রায়, কৃষ্ণগোপাল চৌধুরি, সত্যজিত ঘোষ অনেক নাম। আর তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলে গেল অভিজিৎ বিশ্বাস, আমাদের মিঠুদা। তখনও স্কুলের গন্ডি পার করেনি ও। বিশ্বাস করুন, ওই সময়টা ওকে রূপকথার নায়ক মনে হত। নিজের চেনা স্বপ্নে সওয়ারি হয়ে লক্ষ্যে পা বাড়িয়েছে একজন চেনা মানুষ। সে তো আপনার হিরো হবেই। অন্যদের মত মিঠুদাও গেল কলকাতার ক্লাবে। কুমারটুলি, এরিয়ান। সেখান থেকেই সুযোগ এল ভারতের অনূর্ধ্ব-২১ দলের শিবিরে যোগ দেবার। সবটা স্বপ্নের মতই চলছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে পায়ে চোট পেল। সেই চোট আর সারেনি। মিঠুদার ফুটবল জীবনও তারপর আর আগের মত ডানা মেলেনি।
জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায় একটা চাকরি জুটে গিয়েছিল। ভাল ফুটবলারের সঙ্গে দারুণ ছাত্রও ছিল যে। কিন্তু ফুটবল জীবনটা সত্যিই বর্ণময় হতে পারত ওর। কারণ ফুটবল স্কিলের সঙ্গে জুড়ে গেছিল বুদ্ধি, পড়াশোনা। আমাদের ফুটবল পরিমন্ডলে রেয়ার কম্বিনেশন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাংলার গ্রামেগঞ্জে, মফস্বলে অনেক মিঠুদা এভাবে হারিয়ে গেছে আমরা জানি। এখনও যায়। ওদের সময়ে চিকিৎসা, রিহ্যাব এসব এত উন্নত ছিল না, সে সবের সুযোগও তারা তেমন পায়নি। কিন্তু আজকের দিনেও বহু প্রতিভাবান ফুটবলার চোটের কারণে ফুটবল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কারণ ওই রিহ্যাবের যে খরচা, সেটা চালানোর মত অর্থ তাঁদের কাছে থাকে। কলকাতার আশেপাশে যারা থাকেন, তারা হয়ত তবুও কিছু সরকারি সুবিধায় রিহ্যাব করাতে পারেন। কিন্তু বাকিরা? যারা থাকেন কলকাতা থেকে খানিকটা দূরে? তাঁদের জীবনে চোট মানেই ফুটবল কেরিয়ারে ইতি। ফুটবল খেলায় চোট, আঘাত এসব থাকবেই। কিন্তু প্রতিভাদের বাঁচিয়েও তো রাখতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হল, জেলার এই প্রতিভাদের কে বাঁচিয়ে রাখবে!