বরাবরই করা ধাঁচের মানুষ ছিলেন তিনি। নিজেও খেলতেন বুক চিতিয়ে। কাউকে ভয় পেতেন না। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও খালি পায়ে খেলেছেন। তবে তিনি যত বড় না ফুটবলার ছিলেন, তার থেকেও অনেক অনেক বড় মাপের কোচ ছিলেন। তাঁর হাত দিয়ে ভারতীয় ফুটবলে বেরিয়েছে অসংখ্য মনিমুক্ত। ইস্টবেঙ্গলের সূর্য চক্রবর্তী, মোহনবাগানের করুণা ভট্টাচার্য ছাড়াও, ওনার হাত থেকে বেড়িয়েছেন সামাদ, বলাই চ্যাটার্জি, কার্তিক বসু, রিচে মিত্তির মতো অসংখ্য অসংখ্য ফুটবলার। কমল ভট্টাচার্যের ক্রিকেটার হওয়ার পিছনেও ওনার বিরাট অবদান। এই কারণেই তো উনি স্যার উপাধি পেয়ে ছিলেন। ওনার নামে এরিয়ান ক্লাবে কোচিং সেন্টারও আছে। স্যার দুখিরাম কোচিং সেন্টার। উনি এরিয়ান ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও ছিলেন।
সেই দুখিরাম মজুমদার একদিন নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, তাঁর ভাইপো ছোনে মজুমদারকে ডেকে পাঠালেন। কী ব্যাপার? হঠাৎ কাকা এই সময় ডাকছে কেন? সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বলল, কাকা তুমি ডাকছো? দুখিরাম মজুমদার বললেন, হ্যাঁ। তুমি চট করে খেলার পোশাকটা পরে আসো তো। কাকার ডাক আর কী করে অমান্য করে ভাইপো ছোনে মজুমদার। তিনি খেলার ড্রেস পরে কাকার সামনে হাজির হলেন।
কাকা দুখিরাম মজুমদার তাঁকে একটা পোস্টের সামনে নিয়ে গেলেন। তারপর তাঁকে স্কিপিংয়ের দড়ি দিয়ে পোস্টের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাঁধলেন। ছোনে মজুমদার তো কিছুই বুঝতে পারছেন না। বোঝার কথাও না। ভাবছেন হয়তো কাকা কিছু হার্ড ট্রেনিং করাবেন।
স্যার দুখিরাম মজুমদার তখন ধুতি ও পায়ে কেটস পরে অনুশীলন করাতেন। কিন্তু সেদিনকে আর কেটস পড়লেন না। কেটসের বদলে ধুতি গুটিয়ে পায়ে স্পাইক আলা বুট পড়লেন।
এবং পিছমোড়া অবস্থায় থাকা ভাইপো ছোনে মজুমদারকে, যে ভাবে বাঁশি বাজিয়ে খেলা শুরু হয়, সেই ভাবে বাঁশি বাজিয়ে স্পাইক পড়া বুট দিয়ে ভাইপোর সিনবনে টানা লাথাতে লাগলেন।
তারপর আরেকটি বাঁশি বাজিয়ে লাথি মারা থামালেন। যেমন আর কি খেলার হাফটাইমে বাঁশি বাজে। এবং ভাইপোকে বলেও দিলেন, আজ হাফ টাইম অবধি হল, এরপর যদি শুনি তাহলে ফুল টাইম অবধি হবে। এটা মাথায় রেখো।
ভাইপো ছোনে মজুমদার বুঝতেই পারছেন না তাঁর অপরাধটা কী? যার জন্য এতবড় শাস্তি দিলেন কাকা দুখিরাম মজুমদার।
তাঁর ভাইপো নাকি ইংরেজদের বিরুদ্ধে একটি ম্যাচে পা বাঁচিয়ে খেলেছেন। খালি পা বলে। আর এটা শোনার পর থেকেই চটেছিলেন কাকা দুখিরাম মজুমদার। যিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে বুক চিতিয়ে লড়েছেন, আর তাঁর ভাইপো সেই গোড়াদের বিরুদ্ধে খালি পা ছিল বলে, পা বাঁচিয়ে ফুটবল খেলেছে। এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই ছোনে মুজুমদারকে এমন শাস্তি দিয়ে ছিলেন দুখিরাম মজুমদার।
আরও শোনা যায়, ছোনে মজুমদার অসাধারণ ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু এক পায়ের। বাঁ পা-টা ছিল দুর্দান্ত। কিন্তু কাকা দুখিরাম মজুমদারের এটা মোটেও পছন্দ নয়। তাঁর ভাইপো এক পায়ের ফুটবলার হবে কেন? হলে কমপ্লিট ফুটবলার হবে।
তার জন্য কী করেছিলেন, জানেন? ইট মেরে ভাইপোর বাঁ-পায়ে গুরুতর আঘাত করেছিলেন। তারপর টানতে টানতে নিয়ে গেছিলেন মাঠে। ভাইপোকে বলেছিলেন, এবার ফুটবল খেল।
এই ভাবে তিনি ভাইপোর সচল বাঁ-পা কে অচল করে দিয়ে, অচল ডান পা কে সচল করে তুলেছিলেন।
পরবর্তী কালে উত্তরসূরি হিসাবে স্যার দুখিরাম কোচিং সেন্টারের দেখ ভাল করতেন ছোনে মজুমদারই। প্যান্ট, শার্টের সঙ্গে কাঁধে শাল রাখতেন তিনি। ওনার ক্লাবে বাঘা সোমের কোচিংয়ে মেওয়ালাল খেলেছেন।
এরিয়ান ক্লাবে আর আগের মতো রমরমা নেই স্যার দুখিরাম কোচিং সেন্টারের। কিন্তু সেই কোচিং সেন্টারের রয়ে গেছে অসংখ্য গল্পগাথা।