এক্সট্রা টাইম ওয়েব ডেস্ক : চলতি ইউরো ২০২০তে ইউক্রেনের স্বপ্নের দৌড় অব্যাহত রয়েছে। শেষ ১৬ এ একেবারে অন্তিম মুহুর্তের গোলে সুইডেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে ইউক্রেন, আর এর বড় কৃতিত্ব যায় কোচ আন্দ্রে শেভচেঙ্কোর। নামটা চেনা লাগছে নিশ্চই। বিশ্ব ফুটবলের এক সময়ের ভয়ঙ্কর এই সেন্টার ফরোয়ার্ড আজ ইউক্রেনের ফুটবলারদের মধ্যে নিজের আগ্রাসনকে নিয়ে এসেছেন।
এসি মিলান ও চেলসিতে দাপটের সাথে খেলা এই তারকা ফরোয়ার্ড নিজের কেরিয়ারে প্রচুর সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু শৈশব ও বাল্যকালে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ভুগেছেন শেভচেঙ্কো, সেখান থেকে আজকের এই সাফল্য বুঝিয়ে দেয় যে জীবনযুদ্ধের আসল যোদ্ধা তিনিই।
১৯৮৬ সালে ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় অংশ ছিল। সেই সময়ে আন্দ্রে শেভচেঙ্কোর ১০ বছর বয়স ছিল, আর সেই বছর হয়েছিল কুখ্যাত চেরনোবিল পারমানবিক দুর্ঘটনা। যার জেরে গোটা সোভিয়েত জনজাতির অস্তিত্ব সংকটে এসেছিল। সেই দুর্ঘটনাস্থলের ২০০ কিমি দূরে বাস করতেন শেভচেঙ্কো।
এই ঘটনা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে শেভচেঙ্কো বলেছিলেন, "আমি আশা করব এই ঘটনা শুনে কেউ অবাক হবেন না কারণ এগুলি আমার কাছে সাধারণ ব্যাপার ছিল। আমার ১০ বছর বয়স ছিল, সর্বত্র পাগলের মত ফুটবল খেলতাম। ওরা আমায় ডিনামো কিয়েভ অ্যাকাডেমিতে নিয়ে গিয়েছিল। আর তারপরেই রিয়্যাক্টর ফোরে বিস্ফোরণ ঘটে। আমি এখনও যন্ত্রণায় ভুগি। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বাস এসে ছয় থেকে ১৫ বছর বয়সী আমাদের মত কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে গিয়েছিল। আমি বাড়ি থেকে ১৫০০ কিমি দূরে ছিলাম আর আমার আজও মনে পড়ে যেন আমি কোনও সিনেমার মধ্যে ছিলাম।"
তবে চেরনোবিল ঘটনার থেকেও মর্মান্তিক ঘটনা আসে যখন শেভচেঙ্কোর সকল বন্ধুদের মৃত্যু ঘটে। সেই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের মাঝে তরুণ শেভচেঙ্কোর জীবনেও যেন ভাঙন এসে উপস্থিত হয়।
এই নিয়ে শেভচেঙ্কো বলেছেন, "আমার এলাকায়, আমার আশেপাশের লোকজন কমতে থাকে। আমার সকল বন্ধু মারা গিয়েছিল। বিকিরণের জন্য নয়, মাদক ও অস্ত্রের জন্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়ালের ভাঙন আরও বড় হয়ে উঠছিল, আমাদের পরিচিত জগতটা ক্রমশই তছনছ হয়ে গিয়েছিল। আর বাকিদের মত, আমার বন্ধুরাও সব কিছু থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল আর হারিয়ে গিয়েছিল।"
তবে দুটি জিনিস শেভচেঙ্কোকে জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। এক হল তার পরিবার, আর দ্বিতীয়ত, ফুটবল। শেভচেঙ্কোর ভাষায়, "কেবল আমার পরিবারের ভালোবাসা আর ফুটবল আমায় বাঁচিয়ে রেখেছিল।"
ডিনামো কিয়েভ যেন তার কেরিয়ারকে সঠিক পথে নিয়ে এসেছিল। রিজার্ভ দলের হয়ে মুগ্ধ করে প্রথম দলে সুযোগ পান শেভচেঙ্কো। আর তারপর তার উন্নতি চলতেই থাকে। কিয়েভের হয়ে ৬০ গোল করেন শেভচেঙ্কো। পাঁচবার ইউক্রেন লিগ জিতেছিলেন তিনি। আর তারপর ইউরোপের সেইসময়ের সেরা দল এসি মিলানে রেকর্ড ফিতে সই করেন শেভচেঙ্কো। মিলানেও ফুল ফোটান তিনি।
মিলানের হয়ে ২০৮ ম্যাচে ১২৭ গোল করেছেন শেভচেঙ্কো। ২০০৪ সালে ব্যালন ডি অর জিতেছিলেন তিনি। সেই সময়ে যেন পৃথিবী তার হাতের মুঠোয় ছিল। এরপর চেলসিতে মোটামুটি খেলার পর আবার যেন ফুটবল কেরিয়ারের গাড়ি রিভার্স মোডে ফিরে আসে। চেলসি থেকে ফিরে আসেন এসি মিলানে, আর সেখান থেকে ফিরে আসেন ডিনামো কিয়েভে।
আর এখন নিজের দেশকে গর্বের জায়গায় নিয়ে এসেছেন আন্দ্রে শেভচেঙ্কো। ২০১৬ সাল থেকে এই ইউক্রেন দলটিকে লালনপালন করে এসেছেন তিনি। চেনেন প্রতিটি ফুটবলারের রন্ধ্রকে। ২০১৯ সালে ইউরোপ সেরা দল পর্তুগালকে হারিয়ে ইউরো ২০২০ এর যোগ্যতা অর্জন করেছিল ইউক্রেন। শেভচেঙ্কোর আগ্রাসন যেন এই ইউক্রেন দলে ভরপুর। আর সেই আগ্রাসনকে ভর করে এবার কোয়ার্টার ফাইনালে শক্তিশালী ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হবে তারা।
জীবনের যুদ্ধে অনেকেই হার মেনে নেন, অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু আন্দ্রে শেভচেঙ্কো জানতেন, যতদিন পায়ে ফুটবলটি রয়েছে, আর পাশে পরিবারের সমর্থন রয়েছে - হাজারো চেরনোবিল ও অজস্র সোভিয়েত ভাঙনেও তিনি দমবেন না। কিংবদন্তিরা এভাবেই তৈরি হন।