২৫ বছরের জার্নি | অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়

অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়: একটা অফিসিয়াল কাজেই চেন্নাই থেকে এসেছিলেন ভদ্রলোক। শুরুতে কিছু কাজের কথাবার্তা। তারপর আরও কিছু। ওই ভদ্রলোকই জানতে চাইলেন, সাংবাদিক জীবন কত বছরের? গুনতে শুরু করলাম। আরে, পঁচিশ বছর হয়ে গেল। আরে, কবে হল! কখন হল! এই তো সেদিন বেশ ভয়ে ভয়ে সান্ধ্য আজকালের দপ্তরে ঢুকলাম। ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ শুরু হবে। আজকালে শিক্ষানবীশ সাংবাদিক লাগবে তাদের সান্ধ্য এডিশনের জন্য। আমি তখন সবে অর্থনীতির স্নাতক হয়েছি শ্রীরামপুর কলেজ থেকে। কলেজ জীবন থেকেই চুটিয়ে লিখছি ওভারল্যান্ড আর সংবাদ প্রতিদিনের পাতায়। ওভারল্যান্ডের ক্রীড়া সম্পাদক প্রখ্যাত চিরঞ্জীব। সহ সম্পাদনার দায়িত্বে অমল ত্রিপাঠী। দুর্দান্ত মানুষ। বুঝতেই দিতেন না ফ্রিল্যান্স করি। তখন অবশ্য শুধুই খেলা নয়, অন্যান্য নানা বিষয়ে প্রতিবেদন লিখি। প্রদীপ আচার্য আর অরিন্দম বসু ছিলেন ওভারল্যান্ড ডেস্কে। সাহায্য করতেন খুব। প্রতিদিনে বরং খেলাধুলার সাপ্লিমেন্ট পেজে লিখেছিলাম নিয়মিত। তারপর স্নাতক স্তরের পার্ট টু এগজামিনেশন। সাময়িক বিরতি নিতে হল। ফিরে আসার পর প্রতিদিন স্পোর্টস ডেস্কে নিজেকে কেমন অনাহুত মনে হচ্ছিল। অবশ্য এরকম ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক কত ঘোরাফেরা করে। শূন্যস্থান পড়ে থাকে না। আমার ক্ষেত্রেও ছিল না। সেসময় আনন্দবাজার পত্রিকার শনিবারের সাপ্লিমেন্টে ক্রীড়া সম্পাদক রূপক সাহা লেখালেন কয়েকটা প্রতিবেদন। তারমধ্যে একটা টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির প্রথম ব্যাচকে নিয়ে।

আমি তখন সাংবাদিক হবার স্বপ্নে বিভোর। ব্যান্ডেল লোকাল চেপে ব্যান্ডেল থেকে নিয়মিত আসি কলকাতায়। ফিরে যাই দক্ষিণেশ্বরে কাকার বাড়িতে। কিছুদিনের মধ্যে অবসরের পর বাবাও চলে আসেন নিজের পৈত্রিক বাড়িতে। কাজটা সহজ হয়ে যায়। সে সময়ই একদিন মৌলালি যুব কল্যাণ দপ্তরে আজকালের উদ্যোগে মুকুল দত্ত কর্মশালায় যোগ দিতে এলাম। শিক্ষানবীশ সাংবাদিকের জন্য অনেক প্রখ্যাত সাংবাদিকরাই তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। আমার খুব সুস্পষ্টভাবে মনে আছে রূপক সাহাকেই। পেলের সঙ্গে সাক্ষাতের গল্প বলছিলেন রূপকদা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে শুনছিলাম সবটা। আর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, অন্য কিছু নয়, ক্রীড়া সাংবাদিকই হব। দুটো ছোট টিপস ছিল সেদিন আনন্দবাজারের ক্রীড়া সম্পাদকের। কোনওদিন পাশাপাশি বসে কাজ হয়নি। কিন্তু মেনে এসেছি ওই দুটো কথা। এক, প্রতিদিন দুটো নতুন লোকের সঙ্গে পরিচয় করবে। দুই, নিউজ সোর্স তৈরি হবে তোমার প্রতি বিশ্বাসের ভিত থেকে। তাই নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য তৈরি করার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম আর সততার প্রয়োজন। ক্রীড়া সাংবাদিকতা কিংবা সাংবাদিকতা থেকে নতুন করে বোধহয় আমার পাওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই দুটো টিপস ভবিষ্যতের সাংবাদিকরাও যদি মেনে চলেন, আমার মনে হয় সফল পেশাদার হিসেবে নিজেকে চিনিয়ে দিতে পারবেন।

নিজে কতটা সফল কিংবা ব্যর্থ– সে কোনও ডেবিট-ক্রেডিটের অঙ্ক নিয়ে বসিনি আজ। সাংবাদিকদের জীবন মূলত অন্যের আলোয় আলোকিত হয়। পারফরমেন্সের গ্রাফের ওঠানামা অফিসের এবং ব্যক্তিগত বৃত্ত ছাড়া সেভাবে নজরদারিতে থাকবে না। ২৫ বছরের সাংবাদিকতার জীবন পূর্ণ হবার নিদেনপক্ষে একটা অভিনন্দন বার্তা আসবে না আপনার বর্তমান, প্রাক্তন একজন সহকর্মীর থেকেও। তাই এই স্কোরবোর্ডটা একান্তই নিজস্ব। সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরিগুলোর স্কোরশিটগুলো খুলে একবার নিজের সামনে মেলে ধরাটাও একান্তই ‘মিটাইম’। ২৫ বছর নিয়ে লিখে রাখার ভাবনাটাও এখান থেকেই। আজ থেকে আরও ২৫ বছর পর, স্মৃতি যখন আরও ধূসর, ফিকে—অন্তত নিজে একবার মেলে ধরতে পারব কেরিয়ার স্ট্যাটিসস্টিক্সটা। একান্ত নিজের জন্য। আরও একটা ইচ্ছাও থাকল। ভবিষ্যতে টাটুম-চই যদি কোনওদিন এই লেখাটা পড়ে, অন্তত একটা বিশ্বাস করবে, ওদের বাবা নিজের কাজটা অত্যন্ত মন দিয়ে, সততার সঙ্গে করেছিল। সেটাও কি কম বড় পাওনা?

সেটা ১৯৯৪ সালই। দুর্গাপুরে শৈলেন মান্না- তুলসীদাস বলরাম বেনিফিট ম্যাচ। দুর্গাপুরে আমার মামারবাড়ি। চলে গেলাম সেখানে। কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে তখন আলাপও হয়েছে। রাতে খেলার পর হোটেলে থাকতে দিয়েছিলেন অমরেন্দ্র চক্রবর্তী আর সুগত মুখার্জি। ওঁরা তখন কোনও এক দৈনিকের স্বীকৃত সাংবাদিক। আমি শুধুই ফ্রিল্যান্সার। সে রাতটা ওদের সঙ্গে খাট ভাগাভাগি করে আর পরের দিন বাবুয়াদা (অমরেন্দ্র)-র কাছে টাকা ধার করে টিকিট কেটে কলকাতা ফিরেছিলাম। আর ওখানেই আলাপ হয়ে গেছিল আজকাল পত্রিকার সরোজ চক্রবর্তীর সঙ্গে। সরোজদার সঙ্গে তারও কিছুদিন পর ময়দানে দেখা। ‘কপি সাবিং পার? আজ সন্ধ্যেয় আমার সঙ্গে আজকাল স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টে যেও। আমাদের ওয়ার্ল্ড কাপের জন্য সাব এডিটর লাগবে।‘ সংবাদ প্রতিদিনে ফ্রিল্যান্স করতাম যখন, ওদের ফেলে দেওয়া এজেন্সির কপিগুলো বাড়িতে এনে কপি লেখার অনুশীলনটা ছিল। তাই সরোজদার প্রস্তাবে হ্যাঁ-ই বলে দিলাম। সেসময় প্রতিদিন সন্ধ্যায় ময়দানের ক্রীড়া সাংবাদিক তাঁবু থেকে আজকাল দপ্তর অবধি একটা গাড়ি যেত। ময়দানের কাজকর্ম মিটিয়ে সরোজ চক্রবর্তী, অরুণ সেনগুপ্ত, পার্থ রুদ্র, মুনাল চট্টোপাধ্যায়, অরূপ বসুরা ফিরতেন ডিপার্টমেন্টে। সেই গাড়িতেই জায়গা হল। এক পৃথিবী বিস্ময় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে ঢুকলাম ৯৬, রাজা রামমোহন সরণীর পুরোনো বাড়িটাতে। সরোজদাই আলাপ করিয়ে দিলেন ক্রীড়া সম্পাদক ধীমান দত্তর সঙ্গে। ধীমানদা কপি দিলেন। আদৌ লিখতে পারছি কিনা দেখে নিতে চান। স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের উল্টোদিকেই ছিল খেলা পত্রিকার দপ্তর। সন্ধ্যের পর থেকে সেখানে কাজ হত না। ওই ফাঁকা ঘরটা আমায় দেখিয়ে দেওয়া হল। আমেরিকা বিশ্বকাপ নিয়েই কোনও এজেন্সি কপি। লিখে জমা দিলাম ধীমানদাকে। কপি পড়ে বললেন, কাল চলে এস। সান্ধ্যর কাজ করতে হবে।

সান্ধ্য আজকালের ক্রীরা সম্পাদক ছিলেন রতন ভট্টাচার্য। খুব পছন্দ করতেন আমায়। বিশ্বকাপের জন্য আমার সঙ্গেই আরেক ট্রেনি সাব-এডিটর নিয়েছিলেন ওঁরা। কাঞ্চন সানা। কাঞ্চনদা এখন সুস্বাস্থ্য পত্রিকার সম্পাদক। দু’জনে মিলে সান্ধ্য কাগজের সমস্ত আপডেট লিখে নিতাম। কপি দেখে নিতেন রতনদা। একই সঙ্গে খেলা পত্রিকায় চলতে থাকল লেখা। ‘খেলা’ তখন দেখতেন বিপ্লব দাশগুপ্ত। বিশ্বকাপের মাঝেই অবশ্য কাজের দায়িত্ব সান্ধ্য থেকে প্রভাতী কাগজেও চলে এল। আমেরিকার সঙ্গে সময়ের তফাত অনেকটা হওয়ায় সফরকারী দুই প্রতিবেদক দেবাশিস দত্ত ও জি সি দাসের কপি চলে আসত দুপুরেই। কাজও শুরু হয়ে যেত অনেকটা আগে। আর বিশ্বকাপ মানে আজকালের প্রায় সবক’টা পাতা স্পোর্টসের। অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে কুণাল ঘোষ, সুনন্দ ঘোষ, রাই বড়ুয়ারা এসে কাজ করছেন স্পোর্টসে। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের দুর্দান্ত এক্সক্লুসিভ ছবি আসছে কখনও মারাদোনা, কখনও ম্যাথাঊজ, আবার কখনও রোমারিওকে নিয়ে। ফ্যাক্সে কপি আসছে পাতার পর পাতা। ফিল্ম রোল পৌঁছালে কালার প্রিন্ট নিতে কেউ দৌড়াচ্ছে ধর্মতলা। প্রতিদিন যেন এক সাফল্যের উদযাপন। সবাই মিলে নিজের খেলার পাতাকে পরদিনের কাগজে সেরা হিসেবে মেলে ধরার চেষ্টা। উপভোগ করছিলাম প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত। কিন্তু সব ভালরই তো একটা শেষ থাকে। বিশ্বকাপ শেষ হল। দেবাশিসদারা ফিরলেন। বিশ্বকাপ থেকে একটা পেন এনেছিলেন স্মারক হিসেবে। এখনও মনে আছে সেটা। পুরনো ঘর, বইয়ের শোকেসে খোঁজাখুঁজি করলে এখনও হয়ত খুঁজে পেতে পারি পেনটা। আসলে ছোট্ট ছোট্ট ওইসব মুহূর্তগুলো, স্মারকগুলোই ছিলে জীবনের বিরাট অনুপ্রেরণা। আজকাল স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট প্রতিদিন কতভাবে অনুপ্রাণিত করেছে, বলে বোঝানো যাবে না। যে নামগুলো ছোটবেলা থেকে খবরের কাগজের পাতায় দেখতাম, তাঁদের সঙ্গেই টেবিল ভাগ করে নেওয়া যে কত বড় পাওনা বলে বোঝানো যাবে না। কোনওদিন দেখি দেবাশিস দত্তর সঙ্গে দপ্তরে ঢুকছেন সুনীল গাভাসকার, রবি শাস্ত্রী, আবার কখনও দেখছি আই এম বিজয়নকে বাচ্চা ছেলের মতো বকছেন অরুণ সেনগুপ্ত। আর খুব সামনে থেকে এগুলো দেখে আমার ফিনিশিং লাইনটা ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছিল। লক্ষ্যটা, গন্তব্যটা অনেক দূরেও সম্ভব—বোঝাচ্ছিলেন ওঁরাই। নিজেদের পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা দিয়ে।

বিশ্বকাপটা শেষ হয়ে যাবার পর কী হবে, ভাবনাটা ছিল। সরোজদা বললেন, খেলা-তে লেখ। আমি ততদিনে দৈনিক কাগজে কাজ করার মজাটা পেয়ে গেছি। সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে কী আর পোষায়! তবে ততদিনে একটা বিষয় বুঝে গেছি, এই কাগজে যদি খবর আনতে পারা যায়, তবে কোনওভাবেই তার সঙ্গে আপোষ করা হবে না। ক্রীড়া সম্পাদক ধীমান দত্ত অসাধারণ মানুষ। একটু একরোখা, জেদি, কিছুটা একগুঁয়েও—কিন্তু কাজের ব্যাপারে দুশো শতাংশ সৎ। আজকালে দীর্ঘ সাত বছর কাজের সুবাদে ধীমানদাকে নিয়ে অনেক বিরূপ কিছু শুনেছি নানা সময়, কিন্তু আমার চোখে অনবদ্য মানুষ। প্রচুর বকুনি খেয়েছি, চোখে জল এনে দিয়েছেন কোনও কোনও সময়—কিন্তু কোনওদিন প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে দেখিনি। নিজে যশ, গ্ল্যামারের হাতছানি ছেড়ে অন্যদের সুযোগ দিয়েছেন। নিজে অক্লান্তভাবে টিমের গোলপোস্ট সামলেছেন ওই ৯৬, রাজা রামমোহন সরণীর পুরনো বাড়িটা থেকে।

বিশ্বকাপ শেষ হতেই আমার খবরের খোঁজ শুরু হয়ে গেল। একটা বিষয় দেখলাম, আজকাল স্পোর্টসে ফুটবল, ক্রিকেটে নিজস্ব সাংবাদিকের অভাব নেই। খুব একটা লাভ হবে না সেসব ‘বিট’-এ ঘুরলে। বরং তথাকথিত মাইনর স্পোর্টসগুলোয় লোক কম। সেখান থেকে বড় খবর আনতে পারলে স্টোরি ছাপাও হবে আর মাস শেষে কিছু টাকাও পাওয়া যাবে। সেসময় আজকালে বড় কপি লিখলে ১০০ বা ১৫০ টাকা, মাঝারি কপিতে ৫০ টাকা আর ছোট ডোরিক লিখলে ১০ টাকা দিত আমাদের। তাই যত খবর, তত টাকা। মাস গেলে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা বিল করতেই হত। নাহলে মাস চলবে কী করে! বিশ্বকাপের পর এই মাইনর স্পোর্টস থেকেই প্রথম এক্সক্লুসিভ খবর আমার। আর সেটাই খুলে দিল আমার আজকালে নিয়মিত ফ্রিল্যান্সের সুযোগ। পরবর্তীকালে অন্য একটা খবর আমাকে সেখানে নিয়মিত রিটেইনারশিপের সুযোগ দেয়। অনেকগুলো বছর পর যখন স্থায়ী কর্মী হিসেবে যোগদানের অফার দেয় আজকাল, তখন আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। খাসখবরে টিভি জার্নালিজমে হাতেখড়ি হবার পর অফার এসেছে এবিপি টিভি থেকে। তাই একসঙ্গে ছাড়তে হয় আজকাল আর খাসখবর। তার আগে দুটোতেই চুটিয়ে করেছি ফ্রিল্যান্সিং। খাটনি ছিল বেশ। সকালে খাসখবরের হয়ে খবর সংগ্রহের কাজের পর নবীনা সিনেমায় গিয়ে এডিটিং করানো। সেখান থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিটে আজকাল অফিসে নাইট ডিউটিতে যোগ। নাইট শিফট শেষ করে আজকালের গাড়িতেই আবার হয়ত খাসখবর অফিসে যাওয়া। পরদিন হয়ত আবার ক্যামেরা নিয়ে ছুটতে হবে অন্য কোনও অ্যাসাইনমেন্টে। একদিকে ডেস্কের কাজ, অন্যদিকে রিপোর্টিং, একদিকে প্রিন্ট, অন্যদিকে টেলিভিশন—প্রতিদিনের এই দৌড় আমাকে ভাল কাজ করার সুযোগ দিচ্ছিল প্রচুর। পরিশ্রম ছিল, বেশ কিছুদিন টানা বাড়ি ফেরার সুযোগ হয়নি, এমন দিনও গেছে—কিন্তু শিখছিলামও প্রচুর। পরবর্তীকালে এই সবক’টা মাধ্যমেই প্রচুর অনবদ্য মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েছি, সাংবাদিক জীবন পৌঁছে দিয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, অনেক এক্সক্লুসিভ নিউজ এনে দিতে পেরেছি পাঠক কিংবা দর্শকের সামনে—কিন্তু প্রথম সলতে পাকানো আজকালের জন্য নিয়ে আসা ওই খবরটাই। একজন সাংবাদিকের জীবনে, অনেক কাজের মধ্যে থেকে সেরা ২৫ বাছাই এতটা সহজ নয়। কত স্মৃতি, কত ঘটনা—তবু সেখান থেকে সেরা ২৫ বেছে নিচ্ছি আমি। এই ২৫টা খবর, প্রতিবেদনে আসলে ২৫ বছরের এক-একটা সময়কে ধরে রাখা।

১) অমিতা শিকদারের মৃত্যু

আজকালে আমার প্রথম বাইলাইন খবর। ১৬ পয়েন্টে নিজের নাম দেখতে পাওয়া আর আলাদা বক্সে নিজের কপি দেখতে পাওয়ার আনন্দ সেই প্রথম পাওয়া। খবরটা আমায় আজকাল ক্রীড়া দপ্তরে নিয়মিত যাতায়াতের সুযোগও করে দেয়। সম্ভবত পূর্বাঞ্চল অ্যাথলেটিক্স মিট চলছিল। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে মিটের দু’দিন আগে থেকে ঘুরছি। যদি কোনও খবর পাওয়া যায়। হঠাৎই এসে গেল খবরটা। কাঁচড়াপাড়ায় মারা গেছেন বাংলার অ্যাথলিট অমিতা শিকদার। অমিতা তখন সম্ভাবনাময় অ্যাথলিট। জ্যোতির্ময়ী শিকদারের কাকার মেয়ে। ছুটলাম কাঁচড়াপাড়ায়। হাইন্ডস মাঠে তখন অনুশীলন করান সত্যরঞ্জন রায়। জ্যোতির্ময়ীর কোচ। বেশ কিছু বিখ্যাত অ্যাথলিট তুলছিলেন সত্যরঞ্জনবাবু। সেইসময় বাংলা অ্যাথলেটিক্সের দ্রোণাচার্য। অমিতা তাঁরই ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু সত্যরঞ্জনবাবু যে অভিযোগ করলেন, সেটা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। ‘ডোপিং করে মারা গেছে অমিতা।‘ একই সঙ্গে বেশ কিছু প্রমাণও দেখালেন। আগের বেশ কিছু পারফরমেন্সের সঙ্গে বর্তমান পারফরমেন্সের তুলনা করে বললেন, ১৫ দিনের মধ্যে অন্তত ৭-৮ সেকেন্ড সময় কমিয়ে এনেছে অমিতা। যেটা ডোপিং ছাড়া কোনওভাবেই সম্ভব নয়। ওষুধের ওভারডোজই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ। খবরটা নিয়ে আরও কিছুদূর এগিয়েছিলাম। কল্যাণী হাসপাতাল থেকে অমিতার বাড়ি। জানতে পেরেছিলাম, সেসময় সত্যরঞ্জন রায়কে ছেড়ে নতুন এক উঠতি কোচের তত্ত্বাবধানে ছিলেন অমিতা, যাঁর নিজের একটা মেডিসিনের দোকান ছিল কাঁচড়াপাড়ায়। মৃত্যুর পর সেভাবে প্রমাণের তো কিছু ছিল না, তবে অমিতার মৃত্যুর ওই স্টোরি নিয়ে, বাংলার অ্যাথলেটিক্স মহলে জলঘোলা হয়েছিল বেশ।

২) যুবভারতীতে চেয়ার কেলেঙ্কারি

অমিতা শিকদারের স্টোরি যদি আজকাল ক্রীড়া দপ্তরে আমাকে নিয়মিত লেখা সুযোগ করে দেয়, যুবভারতীর এই স্টোরি আমাকে আজকালে ২০০০ টাকার রিটেইনারশিপের ব্যবস্থা করে দেয়। আমার জীবনের অন্যতম সেরা ব্রেক। সম্ভবত আজকাল পত্রিকাকেও তাদের ইতিহাসে কোনও স্টোরিকে এত বড় ডিসপ্লে দিতে হয়নি। ফ্রিল্যান্স করতাম।

স্টোরির খোঁজে যুবভারতী আর সাই চত্ত্বরে পড়ে থাকতে হত অনেকটা সময়। হঠাৎ একদিন দেখি, যুবভারতীর বাইরে স্তুপাকৃত চেয়ার রাখা। কোথা থেকে এল এত চেয়ার! কৌতুহলবশত স্টেডিয়ামের ভিতরে চোখ রাখতেই চক্ষু চড়কগাছে। দেখি, গোটা গ্যালারি ফাঁকা। ম্যাজিকের মত উধাও হয়ে গেছে গ্যালারির সবকটা চেয়ার। আর সেগুলোই বাইরে স্টোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্য কোথাও। এত চেয়ার লোপাট হয়ে যাচ্ছে, তাও আবার ক্রীড়ামন্ত্রীর নাকের ডগা থেকে! অনুসন্ধানে নামলাম, আর পৌঁছে গেলাম অনেক গভীরে। চেয়ারগুলো আসলে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল সুভাষ চক্রবর্তীর নিজের। কোন একটা ডার্বিতে সমর্থকরা ক্ষোভ জানান চেয়ার ভেঙ্গে। সেই কারণেই সুভাষবাবু সিদ্ধান্ত নেন, বিক্রি করে দেবেন যুবভারতীর সব চেয়ার। একটা অত্যন্ত অনামী পত্রিকায়, চোখে দেখা যায় না এমন একটা সাইজের টেন্ডার ছেপে, খুব অল্প টাকায়, সুভাষবাবু বিক্রি করে দিয়েছিলেন যুবভারতীর সব চেয়ার। চেয়ার কিনেছিলেন কে? সে সময় শিয়ালদহ অঞ্চলের কুখ্যাত সমাজবিরোধী নন্দলাল বোস। নাম শুনে যাই মনে হোক, আসলে বড় মাফিয়া, লোহার স্ক্র্যাপ নিয়ে কালোবাজারি করেন। অনেক খোঁজখবরে তাঁর সন্ধান পেলাম। বাড়িতে যেতেই অভ্যর্থনা জানালেন দেওয়ালে একটা গুলির দাগ দেখিয়ে। দু’দিন আগেই নাকি তাঁর ওপর হামলা হয়েছে। অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। কথায় কথায় স্বীকার করলেন যে যুবভারতীর চেয়ার তিনিই কিনেছেন। বাড়ির পাশেই দেখলাম সমস্ত চেয়ার মেরামত করে আবার শোরুমে যাবার জন্য তৈরি করা হচ্ছে। সেখান থেকেও বিক্রি হচ্ছে। এক একটা চেয়ার ২০০ টাকা। যুবভারতীর সে সময় প্রায় লাখ খানেক চেয়ার এভাবেই বিক্রি হয়ে যায় নামমাত্র দামে। সবার অলক্ষ্যে। আজকালে খবরটা বেরিয়েছিল প্রথম পাতায়। সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত নিজে হেডিং করেছিলেন, ‘কী বলবেন, চেয়ার কেলেঙ্কারি?’ গোটা প্রথম পাতা জুড়ে সেদিন ছিল সেই খবর। একদম ওপরে ফাঁকা চেয়ারশূন্য যুবভারতীর ছবি। নিচে ছবি, বিক্রি হচ্ছে সেসব চেয়ার। আর মাঝে আমার কপি। যুবভারতীতে সুভাষবাবুর সাঙ্গপাঙ্গরা যে খুশি হননি, বলাই বাহুল্য। দু-চারবার রক্তচক্ষুও বরাদ্দ হয়েছিল। কিন্তু তাতে কী, সত্যির একটা আলাদা শক্তি থাকে। সেটাই হাতিয়ার হয়ে যায়।

৩) গ্রেগ চ্যাপেল মিডল ফিঙ্গার

সেই কুখ্যাত ফ্রেম

এই স্টোরির খবর বোধহয় অনেকের জানা। তখন দশ মিনিটের খেল। সৌরভ গাঙ্গুলি বাদ পড়েছেন ভারতীয় দল থেকে, কলকাতা জুড়ে ক্ষোভের আগুন ক্রমশই বাড়ছে। দিকে দিকে বিক্ষোভ আর গ্রেগ চ্যাপেলের কুশপুতুল পুড়ছে। সে সময়ই ভারতীয় ক্রিকেট দল এল ইডেনে ম্যাচ খেলতে। প্রতিপক্ষ সাউথ আফ্রিকা। ভারতীয় দলের প্র্যাকটিস ছিল ইডেনে। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম, ক্লাব হাউসের পাশের গ্যালারি থেকে কয়েকজন দর্শক ক্রমাগত গ্রেগ বিরোধী স্লোগান দিয়ে আসছিলেন। ইন্ডিয়া টিম যখন বেড়িয়ে যাচ্ছে, আমার যেন হঠাৎ মনে হল, বাইরেও কিছু একটা হতে পারে, এই দর্শকরা এত সহজে ছেড়ে দেবে না গ্রেগকে। ক্যামেরাম্যান নন্দনকে বললাম, বাইরে গিয়ে ওয়েট কর। বাইরে তখন তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। নন্দন ক্যামেরাবন্দী রাখছে সবটা। আমি তখন প্রেস কনফারেন্সে। ফুটেজ দেখার সুযোগ হয়নি। অফিসে ফিরে ফুটেজ চেক করে আমি বিস্মিত। এ কি দেখছি! গ্রেগ চ্যাপেল টিম বাসে ওঠার সময় জনতার দিকে মিডল ফিঙ্গার দেখাচ্ছেন। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমাদের স্টোরি দেখে সর্বভারতীয় মিডিয়া বিরাট করে ছেপেছিল ওই খবর। সমস্ত সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেল ফলাও করে দেখায় ওই ফুটেজ, আমাদের থেকে নিয়ে। আপামর সব বাঙালি তখন প্রবল গ্রেগ বিরোধী। সে কারণে ফুটেজ দিয়েও দিই সবাইকে। বিষয়টা নিয়ে হইচই হয়ে ছিল বিস্তর। বিসিসিআই-কেও পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করতে হয় সেই সময়। আই এস বিন্দ্রা বোর্ড সচিব তখন। তিনি প্রেস নোটিশ দিয়ে বলেন, বোর্ডের বার্ষিক সাধারণ সভায় বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হবে আর গ্রেগকে সতর্ক করাও হবে।

৪) লক্ষীরতন শুক্লার বিয়ে

তখন এক সঙ্গে কাজ করছি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায়। একদিকে খাসখবর, একদিকে আজকাল। লক্ষীরতন তখন তরুণ তুর্কি, ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন বিস্ময়। ১৮ বছরও বয়েস হয়নি, আমরা সবাই ভাবছি কবে অভিষেক হবে লক্ষীর। ভারতীয় দলের ১৪ জনের দলে সুযোগ মিলছে, কিন্তু আসল দলে শিকে ছিঁড়ছে না। এমন সময় এক বিকেলে লক্ষীর ফোন। “একবার হাওড়ায় আসবে আমার কাছে? খুব জরুরি দরকার। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি।” অফিসের শেষে গেলাম ঘুষুড়ি। দেখি লক্ষী ঠিকানা বদল করে এক বন্ধুর বাড়িতে আছে। প্রায় গোপন আস্তানা বলতে পারেন। ব্যাপারটা কী? বাকিটা লক্ষীর কথায় এইরকম, “স্মিতার বাড়ি থেকে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে খুব ঝামেলা করছে। কিছুতেই মেনে নিচ্ছে না। বেচারা আমার জন্য খুব সমস্যায় আছে। আমি ওকে বিয়ে করে আমাদের বাড়ি আনতে চাই।” স্মিতার কথা আগেই জানতাম। লক্ষী বলেছিল। আলাপ ছিল না। কিন্তু ওর নিজের বাবা-মাও তো মানবে না। সবে ভারতীয় দলে সুযোগ মিলেছে, সামনে লম্বা কেরিয়ার। লক্ষী জানাল, বাবা-মাকে ও বোঝাতে পারবে। আর এই সমস্যাটা মিটলে তবেই বরং ও আরও খেলায় মন দিতে পারবে। একই সঙ্গে কথা দিল, ক্রিকেটের সঙ্গে কোন আপোষ করবে না কোনদিন। সে রাতটা ঘুষুড়িতেই কাটল ওর সঙ্গে। পরদিন সকালে স্মিতা এল সেই গোপন ডেরায়। হাজির লক্ষীর খুব কাছের জনা তিনেক বন্ধুবান্ধবও। বিয়ে হয়ে গেল একেবারে গোপনে। আমার কী মনে হওয়াতে খাসখবর থেকে একটা ক্যামেরাম্যান ডেকে নিয়েছিলাম। বিয়ের কিছু প্রমাণাদি থাকুক। লক্ষীর বাবা মা তখন উত্তরপ্রদেশে। তারা শুনে বিস্তর চটলেন। কিন্তু স্মিতার বাবা মাকে ফোনে যখন জানালাম, তখন ওরা রাগে কাঁপছেন। ফোনের এই প্রান্তে বসেই মনে হচ্ছিল, গরম সীসা কেউ যেন ভরে দিচ্ছে কানে। বিয়ের ছবি নিয়ে খাসখবরে পৌঁছানোর পর এগজিকিউটিভ এডিটর দিব্যজ্যোতি বসুকে বললাম গোটা ঘটনা। দিব্যদা বললেন, আজই খবর করে দে। লক্ষীকে বোঝা। হ্যাঁ, সেদিন বোঝাতে পেরেছিলাম লক্ষীকে। খাসখবরে সেদিন সন্ধ্যের খবরেই আসে ব্রেকিং, বিয়ে করলেন লক্ষীরতন শুক্লা। পরদিন আজকালেও প্রথম পাতার ছবি ওটাই। তবে আজ থেকে প্রায় ২০/২২ বছর আগের ঘটনাটা প্লেব্যাক করলে দুটো সন্তুষ্টি খুঁজে পাই। এক, লক্ষী কথা রেখেছিল। হয়ত ভারতীয় দলে খেলা দীর্ঘমেয়াদি হয়নি, কিন্তু ক্রিকেটের সঙ্গে ওকে আপোষ করতে কোনদিন দেখিনি। তা না হলে এতগুলো বছর বাংলা ক্রিকেটকে এভাবে সার্ভিস দেওয়া সম্ভব নয় কারও পক্ষে। দুই, ওর অ্যাকাডেমি উদ্বোধনের দিন দেখা শাশুড়ির সঙ্গে। অনেকদিন পর। বললেন, ‘সরি। ওই দিনটার জন্য। কি না বলেছিলাম সেদিন আপনাকে। কিন্তু যা হয়েছিল, সবটা সবার ভালোর জন্য।’ আমরা দুজনেই হাসছিলাম। মাঝে যে কেটে গেছে ২১ টা বছর।

৫) নেতাজির ফেলে যাওয়া রাস্তায়

ডাক ইসমাইল খেলের পথে

২০০৪-এর পাকিস্তান সফর। পেশোয়ার ম্যাচের সময় পাকিস্তানে ভারতীয় দলের সিকিউরিটি অফিসার সোহেল খান জানালেন, তাঁর এক বন্ধুর বাবা নেতাজিকে পায়ে হেঁটে কাবুল পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি এখনও জীবিত। পেশোয়ারেই থাকেন। ঠিকানা জোগাড় করে গেলাম তাঁর বাড়ি। তিনি বাড়ি ছিলেন না, ছিলেন গ্রামের বাড়ি ডাক ইসমাইল খেলে। সেদিন রাতেই আবার পেশোয়ার ছাড়ার কথা। তাহলে উপায়? ঠিক করলাম, রাওয়ালপিন্ডিতে শেষ টেষ্টের সময় একবার চলে যাব সেখানে। তাই করলাম। প্রায় দেড়শো কিলোমিটারের মত রাস্তা। দু’ধারে পাহাড়, নাম না জানা সব নদী সব পেরিয়ে পৌঁছালাম ডাক ইসমাইল খেলে। জায়গাটা একটা পাহাড়ের কোলে। পাহাড়ের নাম চেরহাট রেঞ্জ। পাকিস্তান আর্মির ট্রেনিং হয় এখানে। ৯৬ বছরের আমির খান খটকের সঙ্গে দেখা সেখানেই।

৯৬ বছরের আমির খান খটক

নেতাজিকে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন কাবুল। যৌবনে ফরোয়ার্ড ব্লক করতেন। নেতাজি যেদিন পেশোয়ার স্টেশনে নামেন, সেদিনও আমির খান ছিলেন সেখানে। পাঠানের ছদ্মবেশে এসেছিলেন নেতাজি। প্রথম দিকে থাকতেন পেশোয়ারেই। কিন্তু সিআইডি খোঁজখবর নিতে শুরু করলে চলে আসেন এই ডাক ইসমাইল খেলে। ছিলেন আমির খানের হুজরেতে। পস্তুতে অতিথিনিবাসকে বলা হয় হুজরে। নেতাজি পুলিশের চোখ এড়াতে কোন হুজরেতে ছিলেন, নিজে ঘুরিয়ে আনেন আমির খান। দেখিয়ে দেন পায়ে হেঁটে কাবুল যাবার পাহাড়ি রাস্তা।

নেতাজির অনেক গল্প শুনিয়ে ছিলেন সেদিন

অনেক গল্প করেছিলেন আমির খান। কীভাবে বোবা সেজে নেতাজি রওনা হয়েছিলেন, কীভাবে গোটা দিন হাঁটতেন তাঁরা, পাঠানদের গ্রামগুলোয় কীভাবে রাত কাটানো হত, সব গল্প করেছিলেন আমাদের। ইতিহাসের মিসিং লিঙ্ক ছিল ওটা। ডাক ইসমাইল গ্রামের কথা হয়ত ইতিহাসও জানতে পারেনি। কিন্তু এই গল্পটা বলবেন বলেই হয়ত অপেক্ষা করছিলেন ৯৬ বছরের ওই বৃদ্ধ।

কাবুল যাওয়ার পাহাড়ি পথ দেখাচ্ছেন আমির খান খটক

খোঁজখবরে এই প্রতিবেদন দেখানোর পর হইচই হয়েছিল বিস্তর। ফরোয়ার্ড ব্লক মহাজাতি সদনে পুরো তথ্যচিত্রটা দেখিয়ে সম্বর্ধনা দিয়েছিল আমায়। অশোক ঘোষ তখন চোখে দেখতে পেতেন না। তিনি শুনছিলেন সবটা। ঝরঝর করে কাঁদছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে দু’হাত ধরে অনেক শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। কলকাতার বেশ কয়েকটি পুজো কমিটিও অডিও ভিস্যুয়ালটা দেখানোর ব্যবস্থা করে। সেসব জায়গায় গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে হত। বলতে হত, স্বাধীনতার স্বপ্নে আসলে ঠিক কতটা পথ হেঁটেছিলেন নেতাজি।

৬) সঈদ আনোয়ার আর সেলিম মালিকের সাক্ষাৎকার

২০০৪-এর পাকিস্তান সফর অসাধারণ কিছু অভিজ্ঞতার সুযোগ দিয়েছিল। সেলিম মালিকের সাক্ষাৎকার ছিল এই সিরিজে মনে রাখার মত আরও একটা কাজ। বেটিং-এর অভিযোগে সেই সময় পাকিস্তান ক্রিকেট থেকে ব্রাত্য মালিক। কারও সঙ্গে দেখা করেন না। কেউ দেখা করতে চায় বলেও মনে হয় না। অনেকদিনের চেষ্টার পর ধরা গেল তাঁকে। বাড়িতে আসতে বললেন, তবে সাক্ষাৎকার দেবেন না এই শর্তে। পৌঁছে গেলাম লাহোরে সেলিম মালিকের বাড়ি। মানসিক অবসাদে ভুগছেন। কে বলবে, এই লোকটা কত ম্যাচ একা হাতে জিতিয়েছেন পাকিস্তানকে। সাক্ষাৎকারের একটা লাইন এখনও ভুলতে পারিনা। “আমি সব মেনে নিয়েছিলাম, কিন্তু আমার ছেলেটাকে ওরা স্কুলে ভর্তি নিল না, বাবার নাম সেলিম মালিক বলে। এটা আমি মেনে নিতে পারিনি।” সঈদ আনোয়ারের সাক্ষাৎকারটা অন্যরকম ভাললাগার। পাকিস্তানে পৌঁছানো যাবৎ আনোয়ারের ইন্টারভিউ পাবার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু প্রতিবারই নানাভাবে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন আনোয়ার। ওঁর খোঁজে একসময় একটা মসজিদেও ঢুকে গেছি, অপেক্ষা করেছি যদি তিনি আসেন। পাকিস্তানের স্থানীয় সাংবাদিকরা বলতেন, আনোয়ারের আশা ছেড়ে দিন। তবলিক হয়ে যাবার পর তিনি কারো সঙ্গেই দেখা করেন না। ইসলামে তাদের ধর্ম প্রচারকদের তবলিক বলে। মেয়ের মৃত্যুর পর সঈদ আনোয়ার যে তবলিক হয়ে যান, সেটা আমরা সবাই জানতাম। কিন্তু তবু আনোয়ারের সাক্ষাৎকারটা জরুরি ছিল বলে মনে হচ্ছিল। সুযোগ এসে গেল একেবারে শেষে। রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের সময় টিম হোটেলে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখি চেনা একটা মুখ দ্রুত সরে গেল। মুখে দাড়ি, মাথায় ফেজ টুপি। একেই তো লাস্ট একমাস ধরে খুঁজে বেড়িয়েছি। হোটেলে দেখলাম, সঈদ আনোয়ারের নামে একটা রুম বুক আছে। সেই ঘরে ফোন করলাম, কেউ একজন ফোন ধরে বললেন, রুমে আসুন। রুমে গিয়ে দেখি, কেউ নেই। দেখা করলেন জুনেইদ জাহাঙ্গির। জুনেইদ জনপ্রিয় পাকিস্তানি সিঙ্গার। পরে তবলিক হয়ে যান। তিনি বোঝাতে থাকলেন, সঈদ ভাই কোনভাবে দেখা করতে পারবেন না। ইসলামে ক্যামেরার সামনে আসায় নিষেধ আছে। আমিও তখন গোঁ ধরে আছি। এত কাছে আসতে পেরেছি যখন, দেখা করেই যাব। বললাম, ইন্টারভিউ চাই না। একবার দেখা করি অন্তত। রাজি হলেন ওরা। অন্য ঘর থেকে এলেন সঈদ আনোয়ার। অত্যন্ত বিনীত হয়ে বললেন, সাক্ষাৎকার দেওয়া সম্ভব নয়। আমি বললাম, আপনি জানেন, আমি লাস্ট এক মাসেরও বেশি সময় আপনার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছি। তার কি কোন পুরস্কার থাকা উচিত নয়? কিছু একটা ভাবলেন। আমার হয়ে জুনেইদও অনুরোধ করলেন। অবশেষে রাজি হলেন সঈদ আনোয়ার। আমি নিশ্চিত, ওই সিরিজে আমি ছাড়া আনোয়ারের ধারে কাছে কোন ভারতীয় সাংবাদিক পৌঁছাতে পারেনি।

৭) সুধীর কর্মকার ফিরিয়ে দিলেন সরকারি প্রস্তাব

একটা সময় রাজ্য সরকার নিয়মিত প্রাক্তন ফুটবলারদের বিশ্বকাপ দেখতে পাঠাত। তাঁরা নাকি বিশ্বকাপ দেখে এসে রাজ্য সরকারকে রিপোর্ট দেবে আর সেই রিপোর্ট দেখে বিশ্বকাপ খেলার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করবে রাজ্য সরকার। এইভাবে যে কত সরকারি টাকা নষ্ট করেছিলেন সুভাষ চক্রবর্তী তার বলার অপেক্ষা রাখে না। সুধীর কর্মকার কোন এক সময় আমায় বলেছিলেন, সরকারী অর্থ অপচয় নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা। ব্যাপারটা অনেকদিন মাথায় রেখেছিলাম। বিশ্বকাপের সময় পরিস্থিতি এলে একবার বাজিয়ে দেখব। ১৯৯৮-এ ফ্রান্স বিশ্বকাপ। সরকারি আনুকূল্যে বিশ্বকাপ দেখতে যাবার সময় এল। সুধীরদাকে ফোন করলাম। বললেন, চলে এসো বাড়িতে। রিষড়ায় সুধীরদার বাড়ি যাবার পর বললেন, হ্যাঁ সরকারের ক্রীড়া দপ্তর থেকে ফোন এসেছিল। কিন্তু তিনি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। ব্যস, এই কনফরমেশনটুকুরই দরকার ছিল। পরদিন আজকালে প্রথম পাতায় বড় করে খবর, সুধীর ফেরালেন সরকারি প্রস্তাব। আসলে কিছু কিছু স্টোরি কোনও বিশেষ কারণে মনে থাকে। সুধীরদার এই খবরটা মনে থাকবে শুধু অপেক্ষার কারণে। প্রায় বছর চারেক অপেক্ষা করেছিলাম, কবে আসবে পরের বিশ্বকাপ, কবে আসবে সুধীর কর্মকারের কাছে সরকারি প্রস্তাব।

৮) ইমরান খানের সাম্রাজ্যে পাকিস্তানে

ইমরান খানের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে

কিছু কিছু খবর যেমন অপেক্ষা থেকে আসে, কিছু খবর আসে শুধু দৌড়ে। আমার জীবনে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত এই অবিরাম দৌড় থেকে পাওয়া। কোন সম্ভাবনা নেই, তবু দৌড়ে গেছি। যদি কিছু পাওয়া যায়। পাওয়া গেছেও। ২০০৪ পাকিস্তান সফরে লাহোর টেস্ট চলাকালীন ইমরান খান এলেন একদিন। ধারাভাষ্যর জন্য। একদিনই এসেছিলেন গোটা সিরিজে। তখন থেকেই রাজনীতি নিয়ে প্রবল ব্যস্ত। সেদিন রাতেই তাঁর ক্যান্সার হাসপাতাল শওকত খানুমে চ্যারিটি ডিনার। কোন মিডিয়ার প্রবেশাধিকার নেই। এনডি টিভির তখন প্রবল দাপট। শুধু তাঁদের যেতে বললেন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যাব। কী হবে, বড়জোর ফিরিয়ে দেবে। শওকত খানুমের প্রায় কিলোমিটার তিনেক আগে আমাদের অটো থেকে নামিয়ে দিল। শুধুমাত্র নিমন্ত্রিত অতিথিরা গাড়ি নিয়ে যাবার অনুমতি পাচ্ছিলেন। সেবার আমাদের ক্যামেরাম্যান নিয়ে যাবার অনুমতি দেয়নি পাকিস্তান সরকার। স্থানীয় এক ক্যামেরাম্যান নিয়ে কাজ চালাচ্ছিলাম। তাঁকে সঙ্গে নিয়েই হাঁটতে শুরু করলাম। পুলিশ আটকাচ্ছে, কোনরকমে তাঁদের বুঝিয়ে এগোচ্ছি। হাসপাতালের গেটে গিয়ে বুঝলাম, ভিতরে যাবার কোন সুযোগ নেই। অনেক অনুনয় বিনয় করছি, লাভ হচ্ছে না। হঠাৎ দেখি, এক ভদ্রলোক সামনে ডাকছেন। কোথা থেকে এসেছেন? বললাম, ইন্ডিয়া। বললেন, ওয়েট করুন, আমার সঙ্গে ভিতরে যাবেন। তিনিই ভিতরে নিয়ে গেলেন আমায়। আলাপ হল, পাকিস্তানের খবরেঁ পত্রিকার সম্পাদক কামরান গোরে। ভবিষ্যতে কামরান ভাই হয়ে যান খুব কাছের বন্ধু। হাসপাতালের ভিতরে দেখি, একমাত্র ভারতীয় সাংবাদিক গৌতম ভট্টাচার্য আছেন ভিতরে। গৌতমদা দীর্ঘদিন ইমরানকে চেনেন। বেশ ঘনিষ্ঠ। তিনি পেয়েছিলেন ওই চ্যারিটি ডিনারের আমন্ত্রণ আর আমি ছিলাম অনাহুত অতিথি। তবে চুটিয়ে কাজ হয়েছিল। ইমরান আলাদা ভাবে কথাও বলেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রীকে বেশ কয়েকবার খুব কাছ থেকে পেয়েছি। ভারতীয় ও পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের নিয়ে নৈশভোজের আয়োজন করেছেন ইমরান। আমি আর প্রতিদিনের ফটোগ্রাফার সুমন চট্টোপাধ্যায় পৌঁছে গেছি সেখানে। ২০০৬-এর পাকিস্তান সফরে গেছিলাম, ইমরান খানের ইসলামাবাদের বাড়ি। একটা পাহাড়ের মাথায় সেই বাড়ি। গোটা পাহাড়টা কিনে নিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই বানিয়েছিলেন প্রাসাদ। স্ত্রী জেমাইমা তখন ছেড়ে চলে গেছেন। সেদিন ওই বাড়িটা আর নিজের একাকীত্ব নিয়ে কথা বলেছিলেন ইমরান। এখনও স্পষ্ট কানে বাজে,”জেমাইমার সঙ্গে কাটাব বলে এই বাড়ি। এখন সবটাই নিসঙ্গতা।” সেবার আবার ইমরানের ইন্টারভিউ পেলাম ওর পার্টির অফিসে। কামরান ভাই-ই ব্যবস্থা করে দিলেন। ইসলামাবাদে ওঁর অফিসে বিশ্বাস করুন, একটা লোক নেই। একটা লোক নেই চারপাশে। একটা বড় অফিসে একা বসে। আজকের দিন হলে ভাবা যেত! সত্যি, কীভাবে বদলে যায় মানুষের জীবন।

৯) আনাতোলি কারপভের ইন্টারভিউ

সাংঘিনগরে সেবার ফিডে ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়নশিপের আসর বসেছে। আমি তখনও আজকালে ফ্রিল্যান্সিং করি। সেমিফাইনালে খেলতে এলেন কারপভ, ক্রামনিক, গেলফাঁ আর গাতা কামস্কি। বাংলা কাগজগুলোয় তখনও দাবার খবরগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হত। চলে গেলাম হায়দরাবাদ, ফিডে চেসের সেমি ফাইনাল কভার করতে।

স্বাভাবিকভাবেই এই ধরণের টুর্নামেন্টে এসে আনাতোলি কারপভের সাক্ষাৎকার যদি না পাওয়া যায়, তাহলে কেন আসা! কলকাতা ছাড়ার আগে আজকালের কয়েকজন সিনিয়র সহকর্মীও বললেন, ফালতু যাচ্ছিস। কারপভদের মত প্লেয়ার মিডিয়াকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেবে না! সাংঘিনগরে পৌঁছে সেরকম ব্যবস্থাই দেখলাম। পাহাড়ের কোলে আলাদা গেস্ট হাউস বানিয়ে রাখা হয়েছে কারপভদের। টুর্নামেন্ট এরিনা থেকে অনেকটা দূরে। আমরা থাকতাম শহরে। সাংঘি ইন্ডাস্ট্রিজের তরফ থেকে স্পেশাল বাসের ব্যবস্থা ছিল, বাসেই আসতাম আমরা। টুর্নামেন্ট এরিনা থেকে সামান্য দূরে ছিল বাস স্ট্যান্ড। হেঁটেই ফিরতে হত সেখানে। সাংঘিনগরে পৌঁছানোর দ্বিতীয় দিনই মিলল জ্যাকপট। সকালে বাস স্ট্যান্ড থেকে টুর্নামেন্ট এরিনার দিকে ফিরছি, হঠাৎ দেখি একটা চেনা মুখ পাহাড়ের গায়ের রাস্তাটা দিয়ে নিচের দিকে নামছেন!! আনাতোলি কারপভ! ঠিক দেখছি? দৌড়ে কাছে গেলাম, হ্যাঁ ঠিক তাই। হায়দরাবাদ যাবার সময় ভদ্রক স্টেশন থেকে সম্ভবত একটা বাঁশের শো পিস কিনেছিলাম। ওটা ওঁর হাতে দিলাম। বললাম, আমি কলকাতা থেকে এসেছি। এটা আমার প্রথম অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট, আপনার ইন্টারভিউ চাই। কারপভ একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, আমার সঙ্গে গেস্ট হাউসে এসো। ওখানেই কথা বলব। অনেক কথা বলেছিলেন, ফিডে পিসিএ-র সেই সময়ের ঝামেলা, কাসপরভের সঙ্গে তাঁর টাইটেল ম্যাচ সবকিছু। ব্যাপারটা যতটা সহজ হয়েছিল সেই সময়, আদৌ যে তা নয়, এবার বুঝলাম রাশিয়া ওয়ার্ল্ড কাপের সময়। প্রায় দিন পনেরো তাঁর পিছনে সময় দিয়েও সময় পাওয়া গেল না। তার মাঝে কারপভের সেক্রেটারির সঙ্গে আমার বার দশেক কথা হয়েছে। কিন্তু তিনি অধরা।

১০) খাইবার পাসের পথে

খাইবার পাসের পথে…

পেশোয়ার স্টেডিয়ামে বসেই শুনলাম, ভারতীয় দল যাচ্ছে খাইবার পাস। দীনেশকে জিজ্ঞেস করলাম, কী করবি? যাবি টিম বাসের সঙ্গে? আমাদের ভাবনা চিন্তা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে ভারতীয় দলের বাস বেরিয়ে গেল কনভয়ের পিছনে। খানিকটা পর আমাদেরও সিদ্ধান্ত হল, যা হবার হবে, লেটস ট্রাই। দীনেশ হল দীনেশ চোপড়া। ২০০৪-এ পাকিস্তান সফরেই আলাপ। তখন দীনেশ টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদক। পরে ইএসপিএন আর টাইমস নাউ-এর ক্রীড়া সম্পাদনার কাজও সামলেছে। ২০০৬-এর যে সফরের কথা বলছি, তখন দীনেশ টাইমস নাউ-এর প্রতিবেদক।

ভারতীয় জেনেও সেদিন ওঁদের এক রাশ অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম

ওর ক্যামেরাম্যান করাচির ছেলে জুবেরুদ্দিন আর এক পাঠান ড্রাইভার। আমার সঙ্গে সেই সফরে আমার ক্যামেরাম্যান দেবাশিস সেন। খাইবার পাসে বিদেশি কারো যেতে হলে পাকিস্তান সরকারের অনুমতি লাগে। আর আমরা তো ভারতীয়। ঝুঁকি একশো গুণ বেড়ে যায়। কিন্তু ওই যে স্টোরির নেশা। এটা একটা এমন দৌড় যে লক্ষ্যে না পৌঁছালে কোন বিশ্রাম নেই। খাইবার গেট দিয়ে গাড়ি যখন এলাকায় ঢুকল তখনই বেশ টেনশনে আমরা সবাই। ক্যামেরাগুলো চালান করে দেওয়া হল সিটের নিচে। সিদ্ধান্ত হল, মিলিটারি চেকপোস্টগুলোয় যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে জুবেরুদ্দিন আর পাঠান ড্রাইভারটি কথা বলবেন। গাড়ি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল চারপাশের টোপোগ্রাফিটা। চারপাশে ছোট ছোট পাহাড় আর পাহাড়ের গা দিয়ে চলা খাইবার রেলওয়ের লাইন। খাইবার পাসে আসলে পাকিস্তান সরকারেরও আইন চলে না। এসব জায়গা মূলত পাঠানদের গ্রাম, আর গ্রামগুলোকে বলে কাবিলা। এই অঞ্চলে মূলত ওই পাঠানদের আইনই চলে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে দেখছিলাম, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন কালো পাঠান স্যুট পরা কিছু নিরাপত্তারক্ষী। এখন ভাবি, সত্যিই যদি ওদের হাতে ধরা পড়ে যেতাম সেদিন, কী হাল হত আমাদের!! এটা তবুও ২০০৬-এর কথা, ২০০৭ থেকে তো এই অঞ্চলের দখল নিয়ে নেয় তালিবানরা। তখন এসব করলে যে কী হত! যাক ওইভাবেই পৌঁছালাম খাইবার পাস মিউজিয়ম অবধি।

ফুটবল পায়ে নেমে পড়লাম খাইবার পাসের মাঠে

একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তান বর্ডার। আমি তখন ভেসে গেছি ইতিহাসে। এই সেই রাস্তা। সেই বিখ্যাত সিল্ক রুট। যে রাস্তা দিয়ে শক, হুন, পাঠান, মোঘল সবাই এসেছে ভারতবর্ষে। খিদে পেয়েছিল বেশ। পাশেই মার্কেট। সেখানে একটা দোকানে ঢুকলাম। ওরা বানিয়ে দিলেন দুম্বে কা গোস্ত। পেশোয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত খাবার। দোকানে যখন বসে আছি, দেখি মাংস কাটল যে ছেলেটা, সে এক টুকরো কাঁচা মাংস তুলে মুখে দিয়ে দিল। সেটা দেখে দেবাশিস সেনের কথাটা এখনও মনে আছে। “আচ্ছা, ওরা কি আমাদের এভাবেই কাঁচাই খেয়ে ফেলবে!’’ আবার এক বুক ভয় নিয়ে ফেরার পালা। অনেকটা আসার পর দেখি খাইবার গেটটা দেখা যাচ্ছে। মানে শান্তি। পাশেই একটা মাঠে দেখি ফুটবল খেলছে কয়েকজন তরুণ। ওদের কাছে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলাম। ফুটবল খেললাম ওদের সঙ্গে। অনেক কথা বললেন ওঁরা ভারত আর পাকিস্তান নিয়ে। সাধারণ মানুষ ভাবেই না ভারত শত্রু, ভারতের মানুষ পাকিস্তানিদের শত্রু। তবু তাঁদের ভাবানো হয়, দুটো দেশেই।

১১) অমল দত্তর সঙ্গে কারশেডে

ডায়মন্ড বছরেই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করে বসেছিলেন অমল দত্ত। রোভারস কাপে চার্চিলের সঙ্গে গড়াপেটা খেলেছিল মোহনবাগান। পুরো ঘটনাটার ব্লু প্রিন্ট করেছিলেন গজু বসু, কিন্তু জানতেন অমল দত্ত। অঞ্জন মিত্র, টুটু বসুরা মুম্বইয়ে থাকতেই কোচকে অপসারণের চিঠি ধরান। টুর্নামেন্ট শেষে মুম্বই মেলে ফিরছিল মোহনবাগান। একই ট্রেনে আর একই কম্পার্টমেন্টে ফিরছিল ইস্টবেঙ্গলও। অমল দত্তকে আলাদা করে ধরাটা খুব জরুরি ছিল। তাঁর প্রতিক্রিয়া তখনও কোন কাগজ পায়নি। আমি ভাবলাম, দুটো টিমকে একসঙ্গে পেতে হলে একটু আগে ট্রেন উঠতে হবে। উঠব কোথায় থেকে? ঠিক করলাম, খড়গপুর চলে যাব। মুম্বই মেল কলকাতায় ঢোকে সকালের দিকটায়। তাই আগের রাতেই সেখানে যেতে হল। সারারাত প্লাটফর্মেই কাটল। সকালে ট্রেন ঢুকতেই একটা প্লাটফর্ম টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে পড়লাম। ট্রেনে বাকিদের সঙ্গে কথা হল। কিন্তু অমল দত্ত চুপ। কথা বলছেন না। বুঝছিলাম, কথা বলবেন না সবার সামনে। আবার হাওড়া স্টেশনে প্রচুর অন্য মিডিয়াও থাকবে। কী করা যায়? ছোট্ট একটা মিথ্যে বলতে হয়েছিল সেদিন। বলেছিলাম, হাওড়া স্টেশনে কিন্তু আপনাকে নিয়ে বিক্ষোভ হতে পারে। অমলদা একটু বিমর্ষ হয়েছিলেন। এর মধ্যে কারশেডে গাড়ি থামল। অমলদাকে পরামর্শ দিলাম, এখানে নেমে যান। চলুন আপনাকে আমি ছেড়ে আসছি। অমলদা রাজি হয়ে গেলেন। সঙ্গে নামলেন গোলকিপার বিভাষ ঘোষও। ট্যাক্সি অবধি যাবার আগেই সাক্ষাৎকার দিলেন ডায়মন্ড কোচ। ঘটনার পর প্রথমবার।

১২) সুনামির খোঁজে

২০০৫-এ শ্রীলঙ্কা সফরে যখন গেলাম, সুনামির স্মৃতি তখনও টাটকা। ত্রিদেশীয় সিরিজ, ভারত প্রথমে খেলল ডাম্বুলায়। ছবির মত এটা জায়গা, সেখানেই ক্রিকেট স্টেডিয়াম। পরে খেলা হল কলম্বোতে। সেখানে থাকাকালীন একদিন রওনা হলাম গল আর মাতারার দিকে। কলম্বো থেকে গলের এই জার্নিটা অসাধারণ। সমুদ্রের গায়ে দিয়ে রাস্তা, বিস্তৃত বিচ, কোথাও কোথাও সমুদ্র একেবারে রাস্তাকে ছুঁইয়ে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই পথের দুধারে তখন অনেক কান্না জমে। প্রচুর মানুষ তখনও দাঁড়িয়ে এই আশায় যে তাঁদের প্রিয় মানুষ যদি ঢেউয়ের জলে ভেসে আবার ফেরত আসেন ডাঙ্গায়। কারণ সমুদ্র তাঁদের টেনে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেছে, আর ফেরত দেয়নি। এক মা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর মেয়ের ছবি হাতে, জনে জনে জানতে চাইছিলেন, কেউ কি তাঁর মেয়ে কে দেখেছে? গলে পৌঁছানোর আগে সেই ট্রেনটা দেখলাম, সুনামি যে চলন্ত ট্রেনটাকে বাদামের খোলার মত তুলে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেছিল। দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে সবটা। সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গেছিলেন মুরলিথরণ। কিন্তু গল স্টেডিয়ামটা? ধ্বংসাবশেষ দেখে এসেছিলাম তাঁর। সেখানকার পিচ রোলারটা তুলে ভাসিয়ে দিয়েছিল সুনামি। এতই ভয়াল ছিল তার চেহারা। আর মাতারায় গেছিলাম সনথ জয়সূর্যের আদি বাড়ি। এখানেই ছোটবেলা কেটেছিল মাতারা ড্যাশারের। জয়সূর্যের বাবা মা দুজনই ছিলেন বাড়িতে। সুনামির ভয়ংকর দিনটার কথা শুনিয়েছিলেন তাঁরাও। জয়সূর্যের মাকে সেদিন সুনামির ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু ঈশ্বরের অসীম কৃপায় একটা গাছে আটকে যান তিনি। বেশ কয়েকঘণ্টা ওইভাবেই আটকে ছিলেন। সমুদ্রের জল নেমে গেলে তাঁকে উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন জয়সূর্যের মা। কয়েকদিন আগে কলকাতায় এসেছিলেন জয়সূর্য। একসঙ্গে গেছিলাম খড়গপুর, একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনালে। জয়সূর্যকে বলছিলাম সেদিনের গল্প। জানালেন, মা এখনও ভাল আছেন, বাবা একটু অসুস্থ। কিন্তু সেদিন সেই গাছটা না আটকালে কী হত কে জানে।

১৩) স্মৃতি

স্মৃতিকে আমি ভুলতে পারিনা। স্মৃতির জন্মের সঙ্গে বাংলা ফুটবলের এমন একটা কালো স্মৃতি জড়িয়ে যেটা আপনাকে নাড়িয়ে দেবেই। খেলা পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় ১৯৮০-র ১৬ অগাস্টে ইডেনে মৃত ১৬ জন ফুটবল সমর্থকের পরিবার নিয়ে একটা প্রতিবেদন লিখি। প্রায় দেড় দশক পর এই পরিবারগুলো খুঁজে বার করা সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু বেশ কয়েকটা পরিবারকে খুঁজে পাই। তার মধ্যে বাগমারির অলোক দাসের পরিবারের মেয়েটাকে আমায় ভুলতে দেয়নি। মেয়েটার নাম ছিল স্মৃতি। হ্যাঁ, ১৬ অগাস্টের স্মৃতি মনে রাখতেই ওর নাম হয়েছিল স্মৃতি। প্রসবের সময়ই ওর মা মারা যান। বাবা অলোক ভীষণ ভেঙে পড়েন। মোহনবাগানের সমর্থক ছিলেন। বন্ধু বান্ধবরাই বুঝিয়ে সেদিন মাঠে নিয়ে যায় মন খারাপ কাটাতে। অলোক আর ফেরেননি। স্মৃতি তখন ৩ কিংবা ৪ দিনের। এক জেঠিমা মানুষ করেন। আমি যেবার ওদের বাড়ি গেলাম প্রথমবার, স্মৃতির তখন ১৬ বছর বয়স। মা বাবা কাকে বলে জানা হয়নি। একটা ফুটবল ম্যাচ কেড়ে নিয়েছিল ওর শৈশবের সবচেয়ে মধুর আশ্রয়। স্মৃতিকে নিয়ে পরেও বেশ কয়েকবার স্টোরি করেছি। এক্সট্রাটাইমে। স্মৃতি এখন নিজে মা। এখনও প্রতি ১৬ অগাস্ট চলে আসে নেতাজি ইন্ডোরে, রক্তদানের আসরে। কলকাতা ফুটবলের একটা কালো দিনকে স্মৃতি করে কলকাতায় একটা মেয়ে বড় হয়েছে, বেঁচে আছে, এটা বোধহয় অন্যরকমের উপলব্ধি।

১৪) ব্যারেটোর সেই রাত

কয়েকদিন আগেই ওঁর বাড়িতে ক্রিসমাস উদযাপনে সামিল হয়েছি। ব্যারেটো আর ওঁর পরিবার খুশিতে ভরপুর ছিলেন। কেক বানিয়ে খাইয়েছিলেন ভেরনিকা, ক্যারল গেয়েছিলেন ব্যারেটো আর তাঁর কয়েকজন ব্রাজিলিয়ান বন্ধু। মোহনবাগানে তখন তুমুল গণ্ডগোল। আদালতের নির্দেশে টুটু বসু-অঞ্জন মিত্রদের জায়গায় ক্লাব পরিচালনায় এসেছেন বলরাম চৌধুরি, কেষ্ট সাহারা। ব্যারেটোর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক প্রথম থেকেই তেমন জমাট বাঁধেনি। ব্যারেটোকে বলরামরা অঞ্জন-দেবাশিসের ফুটবলার ভাবতেন, ব্যারেটোও বিশ্বাস করতে পারেননি ওদের। সদ্য গোয়াতে খেলে এসেছে মোহনবাগান। দূরত্বটা বোধহয় আরও বেড়েছিল। হঠাৎ একদিন রাতে ওকে ফোন করেছি, ব্যারেটো জানাল, মোহনবাগান ছেড়ে দেশে ফিরে যাচ্ছে ও। সিজনের মাঝপথেই। তখন আমরা দশ মিনিটের খেলে কাজ করছি। রাতেই আমার রিপোর্টার সুপ্রিয় রায় কর্মকারকে পাঠালাম ওঁর কাছে। ব্যারেটো সাক্ষাৎকার দিলেন। বলে দিলেন, ফিরে যাচ্ছেন তিনি। একটা দীর্ঘ সময় সবুজ মেরুন থেকে ব্যারেটোর সরে থাকা সেই সময় থেকেই। দশ মিনিটের খেলে সেই খবর রাতে সম্প্রচারিত হবার পরই বলরামবাবুরা তাঁর বাড়িতে যান, কিন্তু ব্যারেটোর সিদ্ধান্ত বদলানো যায়নি। পরদিন সকাল থেকে দেখেছিলাম ওঁর বাড়ির বাইরে সমর্থকদের ভিড়। ব্যারেটো তখন কসবার নীলাচল আবাসনে থাকতেন। আবাসনের পাঁচিলে দাঁড়িয়ে সমর্থকরা ওঁকে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করতেন। কিন্তু ব্যারেটো তখন সরে এসেছেন অনেকটা। প্যাকিংও শুরু করে দিয়েছেন।

১৫) বারবোসা নাসিমেন্টোর খোঁজে

বারবোসা নাসিমেন্টোর সমাধি স্থল

২০১৪-এর ঠিক ৬৪ বছর আগে ১৯৫০-এ বিশ্বকাপের আসর বসেছিল ব্রাজিলে। আর ২০১৪-র মতই ১৯৫০-এর বিশ্বকাপও অভিশপ্ত হয়ে গেছিল ব্রাজিলের জন্য। ফাইনালে ঘরের মাঠে সেদিন ২ লাখ দর্শকের সামনে উরুগুয়ের কাছে ২-১ গোলে হেরেছিল ব্রাজিল। মারাকানা স্টেডিয়ামে সেদিন তিল ধারণের জায়গা ছিল না। কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি ব্রাজিল ফাইনালে হারতে পারে। কিন্তু সেটাই হয়েছিল। আর গোটা ব্রাজিলের চোখে ভিলেন হয়ে গেছিলেন ব্রাজিলের গোলকিপার বারবোসা নাসিমেন্টো।

মৃত্যুর শেষদিন অবধি সেই যন্ত্রণা ভুলতে পারেননি বারবোসা। ১৯৯৩-এ ব্রাজিল জাতীয় দলের ক্যাম্পে যেতে চেয়েছেন, ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন অনুমতি দেয়নি, তিনি নাকি দলের জন্য আনলাকি হবেন। মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “ব্রাজিলে খুনের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০ বছরের জেল। আর আমি ৫০ বছর ধরে শাস্তি পেয়ে যাচ্ছি।” ২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিল যাবার সময়ই মাথায় ছিল, বারবোসার খোঁজে যাব। প্রায়া গ্রান্দে বলে একটা জায়গায় থাকতেন প্রাক্তন এই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার। সাওপাওলো থেকে ৫ ঘণ্টা সময় লাগল প্রায়া গ্রান্দে পৌঁছাতে। আটল্যান্টিকের পাশে ছবির মত সাজানো ছোট্ট একটা শহর। ব্রাজিলে সেটা আমার দ্বিতীয় দিন। সাওপাওলো থেকে বাসে চেপে চলেছি। সঙ্গে দুটো বড় স্যুটকেস। সেখানে পৌঁছাতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। কেউ এক বর্ণ ভাষা বোঝেন না। বুঝতে পারছি, রাতে আর সাওপাওলো ফিরে যাওয়া হবে না। ছোট্ট একটা মোটেলের সন্ধান পেয়ে রাতটা সেখানেই কাটালাম। মালিক আর তাঁর স্ত্রী চালান সেটা। সকালে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিলেন ওরাই। আর আমি বেড়িয়ে পড়লাম বারবোসার সন্ধানে।

বারবোসার পাবের সামনে

আটল্যান্টিকের পাশে বিচের ওপরেই একটা পাব চালাতেন তিনি। নিজের স্ত্রীর নামে ছিল সেই বারের নাম। জীবিতকালেই সেটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এখন যাঁরা চালান, তাঁরা বারবোসাকে নিয়ে কিছু বলতে পারলেন না। ইতিহাস তো কোনদিন ট্রাজিক হিরোদের মনে রাখেনি। স্থানীয় একটা সমাধিক্ষেত্রেই বরং ওঁর খোঁজ পেলাম। গোটা সিমেট্রি জুড়ে ছোট ছোট স্মৃতিক্ষেত্র করা আছে। সেখানেই একটা জায়গায় দেখলাম বারবোসার ছবি। লেখা আছে ওঁর নাম, জন্ম আর মৃত্যুর তারিখ। সেখানেই রাখা একটা মা মেরির ছোট্ট মূর্তি।

বারবোসার সমাধিস্থলে রেখে এসেছিলাম মাদার টেরিজার একটা মূর্তি

ঠিক তার পাশেই মাদার টেরিজার একটা মূর্তি রেখে এসেছিলাম। প্রায়া গ্রান্দা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দুরের একটা ফুটবলের শহর অন্তত তাঁকে মনে রেখেছে। মনে মনে বলে এসেছিলাম, এখন শান্তিতে ঘুমোন মিঃ বারবোসা।

১৬) ব্রায়ান লারা গেলেন কোথায়?

সেটা ১৯৯৪ সাল। কলকাতায় ট্রাঙ্গুলার সিরিজের ফাইনাল। ইন্ডিয়ার প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সে সময় গোটা ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে একটাই আলোচনা, কে বড়? শচীন না লারা? লারাকে নিয়ে প্রবল উৎসাহ চারিদিকে। আমি তখন আজকালে। সবে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছি। হঠাৎ দেখলাম আমার নামে ইডেনের ম্যাচ কভারেজের জন্য অ্যাক্রিডেশনও করা হচ্ছে। প্রচণ্ড মোটিভেটেড আমি। ভাল স্টোরি করতেই হবে। কিন্তু স্টোরি কোথায়? ক্রিকেটারদের ধারেকাছে পৌঁছানো মুশকিল। কিন্তু ওই যে খবরের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই ৫০ শতাংশ কপাল। কপালে থাকলে আপনি কিছু পাবেনই। বাকিটা আপনার বুদ্ধিমত্তা, পরিশ্রম, লেগে থাকা সবটা সাহায্য করবে। খেলার দিন ইডেনের বাইরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। ভিতরে খেলা শুরু হয়ে গেছে। ইন্ডিয়া প্রথমে ব্যাট করছে। হঠাৎ দেখি, ব্রায়ান লারা বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছেন! আজকের ক্রিকেট হলে আইসিসির অ্যান্টি করাপশন ইউনিট হইচই ফেলে দিত। কিন্তু তখনও খেলা শুরু হবার পর দলের এক নম্বর ক্রিকেটারের এই ভাবে বেড়িয়ে যাওয়াটা খুব অবাক করেছিল। লারা ফিরলেন খুব তাড়াতাড়ি। বুঝলাম, কাছেই কোথাও গেছিলেন। সেই সময় বিদেশি দল থাকত গ্র্যান্ড হোটেলে। ইডেন থেকে কয়েক মিনিট। মনে হল, হোটেলেই গেছিলেন লারা। গ্র্যান্ডে গেলাম, সেখান থেকেই খবর পেলাম এক মহিলা অতিথির জন্য টিকিট রেখে আসতে তিনি ফেরেন হোটেলে। সে ম্যাচে লারা রান পাননি। কিন্তু আজকালে পরের দিন সকালে প্রথম পাতায় বড় স্টোরি ছেপে বেড়িয়েছিল, ম্যাচ চলাকালীন কোথায় গেলেন লারা?

১৭) মারাদোনার খোঁজে

বান্ধবি ভেরোনিকা ও পুত্র ফারনান্দোর সঙ্গে রেস্তোরায় মারাদোনা

২০১৪ বিশবকাপ। রিওর কোপা কাবানাতে ফ্যান জোনের মিডিয়া সেন্টারে বসে আছি। অফিসে কিছু স্টোরি ফাইল করার ছিল, নেট চেক করারও দরকার। হঠাৎ দেখি একটি বিশ্বকাপ দলের ফুটবলাররা মারাদোনার সঙ্গে সেলফি পোস্ট করেছেন সোশাল মিডিয়ায়। মারাদোনার সঙ্গে একই হোটেলে আছেন ওরা। বুঝতে পারলাম, মারাদোনা চলে এসেছেন ব্রাজিলের মাটিতে। কিন্তু কোথায় আছেন? কীভাবে জানা যাবে? ছবিটা মিডিয়া সেন্টারের ভলিন্টিয়ারদের সবাইকে দেখাতে শুরু করলাম। কোন হোটেল কেউ যদি বলতে পারে! শেষ অবধি, স্থানীয় একটি ছেলে দেখে বলল, অ্যারিস্ট্রোক্র্যাট হোটেল। কোপা কাবানা বিচ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই। ব্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা দিলাম সেদিকেই। রাত অনেক তখন। হোটেলের বাইরে দেখি, আর্জেন্টিনার একটি চ্যানেলও হাজির হয়ে গেছে মারাদোনার জন্য। হোটেলে ঢোকার অনুমতি নেই। বাইরেই অপেক্ষা করছি আমরা। আর্জেন্টিনার মহিলা সাংবাদিকটি জানালেন, একটু পরেই মারাদোনা নামবেন ডিনারে। অপেক্ষা বাড়ল। একেবারে পাপারাৎজিদের ভূমিকায়। একটু পর মারাদোনা নামলেন, দেখি কোলে একটা বাচ্চা। আর্জেন্টিনার মেয়েটি জানালেন, এটা ভেরোনিকার গর্ভে মারাদোনার শিশু পুত্র। নাম, দিয়াগো ফারনান্দো মারাদোনা। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখান থেকে রেস্তোরাঁটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ছেলে কোলে মারাদোনার প্রচুর ছবিও হল।

দুঙ্গার সঙ্গে হোটেলের লবিতে হঠাৎ দেখা মারাদোনার

পরেরদিন আবার চলে এলাম হোটেলে। সিকিউরিটিকে ম্যানেজ করে লবিতেও বসলাম। আমার সঙ্গী হাওড়ার ছেলে অরুনাভ কর। অরুনাভ বিশ্বকাপ দেখতে ব্রাজিল গেছিল, মারাদোনাকে দেখার চান্স হতে পারে শুনে আমার সঙ্গী হয়েছে। হঠাৎ সেখানে দেখি দুঙ্গা ঘুরছেন। কলকাতার কথা বললাম। বললেন, মনে আছে কলকাতাকে। তারপরই মারাদোনা নামলেন। কোলে বাচ্চা। ইন্টারন্যাশানাল ব্রডকাস্টিং সেন্টারে যাবেন ভেনেজুয়েলার একটা টিভি চ্যানেলের হয়ে কাজ করতে। দুঙ্গার সঙ্গে ওঁর লবিতেই দেখা হল। দু’জনে কথা বললেন অনেকক্ষন। ১৯৮৬-র আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক আর ১৯৯৪-এর ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক একই ফ্রেমে। আমি আর ভেনেজুয়েলার ওই টিভি চ্যানেল ছাড়া বিশ্বের কেউ সেখানে নেই।

মারাদোনার হাতে যুবভারতীর সেই ছবিটা

মারাদোনা আইবিসি রওনা হবার পর ঠিক করলাম, সেখানে যাব। মারাদোনা ফ্রেমে থাকা মানেই ছবি, খবর। শহরের বাইরে তৈরি হয়েছিল আইবিসি। বিশ্বের সব টিভি চ্যানেল এই জায়গা থেকেই ব্রডকাস্ট করে। আইবিসি গিয়ে ভেনেজুয়েলা টিভির স্টুডিওর বাইরে অপেক্ষা করছি। মারাদোনা বের হলেন। সঙ্গে আরো অনেক মানুষ। আমি সঙ্গে মাদার টেরেসার একটা মূর্তি নিয়ে গেছিলাম। আর সল্টলেক স্টেডিয়ামে গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর সেই বিখ্যাত ছবিটা। মাদারের মূর্তিটা হাতে নিলেন। ছবিটা হাতে নিয়ে কিছু একটা বললেন। আমি আন্দাজ করে বললাম, ইন্ডিয়া। দুবার নিজে উচ্চারণ করলেন, ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া। তারপর বেরিয়ে গেলেন। রিওতে তখন রাত প্রায় তিনটে। তখনও দেখি, আইবিসি-র বাইরে মারাদোনাকে নিয়ে গান গাইছেন কয়েকজন সমর্থক। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম সবটা। এই লোকটার জন্য হাজার হাজার মাইল রোজ হাঁটা যায়।

১৮) সৌরভের বাড়িতে সারপ্রাইজ

সৌরভের বাড়িতে পেলাম একটা অসাধারন সারপ্রাইজ

“কোথায় আছো? কী করছো?” সৌরভের ফোনটা যখন এলো, তখন জাস্ট সন্ধ্যে নেমেছে। বললাম, ‘এই তো অফিসেই আছি।’ “চলে এসো আমার বাড়িতে। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।” অফিস থেকে বেড়িয়ে বেহালার দিকে রওনা হলাম। আমি যখন পৌঁছালাম, সৌরভ তখনও এসে পৌঁছাননি। কিছুক্ষন পর ঢুকলেন, সঙ্গী আরও এক পরিচিত মুখ, আমির খান। বাকি গল্পটা আপনাদের সবার জানা। থ্রি ইডিয়টস সিনেমার প্রচারে এসেছিলেন আমির। সকালে ছদ্মবেশে গেছিলেন সৌরভের বাড়ি। বিকেলে সৌরভ নিজে নিয়ে আসেন ডিনারের জন্য। সঙ্গে আমিরের স্ত্রী কিরণ রাও। প্রচুর আড্ডা, প্রচুর গল্প গোটা সন্ধ্যে জুড়ে। ডিনার টেবিলেও অনেক আড্ডা, যেগুলো থেকে যাবে স্মৃতিতেই। পরবর্তীকালে আনন্দ প্লাসে এই সন্ধ্যেটা নিয়ে লিখিয়েছিলেন গৌতম ভট্টাচার্য।

১৯) মেসির হাতে দুর্গামূর্তি

মেসির হাতে তুলে দিলাম দুর্গামূর্তি

এবিপি আনন্দে প্রমোশনটা চলছিল এইভাবে। ‘কলকাতায় মেসি আর এবিপি আনন্দে এক্সট্রা টাইম’। ২০১১ সাল। ২৪ ঘন্টা চ্যানেলে ৫ বছরেরও বেশি এক্সট্রা টাইম চলার পর সেবারই এল এবিপি-তে। ওরা অনেকদিনই চাইছিল যাতে এক্সট্রা টাইম চলে সেখানে। শেষ অবধি তাই হল। ২০১১-এর ২ সেপ্টেম্বর, আমাদের সম্প্রচার শুরু হল এবিপিতে। কিন্তু প্রথমদিনেই তো একটা বড় চমক চাই, কী হতে পারে! মেসিদের টিমের লোকাল ম্যানেজার গোপাল ঘোষকে বলে রেখেছিলাম, যদি সুযোগ হয়, মেসির সঙ্গে দেখা করিও। ১ সেপ্টেম্বর বিকেলে গোপালের ফোনটা এলো, হোটেলে চলে এসো। আমি ওদের কোচ স্যাভিওলাকে বলে রেখেছি। কিছু একটা ব্যবস্থা হতে পারে। আমার সঙ্গী হল ক্যামেরাম্যান নন্দন পাল। কেনা হল দক্ষিণাপন মার্কেট থেকে ডোকরার দুর্গামূর্তি। .

মেসিকে দেওয়ার জন্য। মেসিরা থাকছিলেন স্টেডিয়ামের পাশেই একটা হোটেলে। প্রচুর সিকিউরিটি চেক করার পর হোটেলে ঢোকার অনুমতি মিলল। বিকেল থেকে শুধুই অপেক্ষা। ওই ইভেন্টের অফিসিয়াল চ্যানেল ছিল, চ্যানেল টেন। তাঁদের রিপোর্টাররা ম্যান মার্কিং শুরু করে দিয়েছে। কী উদ্দেশ্যে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি। আমরাও তাঁদের বিভ্রান্ত করতে কখনও স্মোকিং জোনে, কখনও কফি হাউসে গা ঢাকা দিচ্ছি। তারপরই গোপালের কাছ থেকে ফোনটা এলো। ব্যাংকোয়েটের দিকে চলে এসো, স্যাভিওলা আসছেন, তোমাদের ভিতরে নিয়ে যাবেন। তাই হল, আর্জেন্টিনা কোচ নিজে এসে নিয়ে গেলেন তাদের ডিনার টেবিলে। নিজেই ডাকলেন মেসিকে। মেসির হাতে দুর্গামূর্তিটা তুলে দিয়ে বলেছিলাম, মা দূর্গা আমাদের শক্তি দেন। শক্তিরূপে পূজো করি আমরা।

মন দিয়ে সবটা শুনেছিলেন মেসি। দোভাষী স্প্যানিশে তর্জমা করে দিচ্ছিলেন। পরদিন সকালের এবিপি আনন্দের এক্সট্রা টাইমে (ওখানে সকালেও হত এক্সট্রা টাইম) ব্রেকিং হল, মেসির হাতে দুর্গামূর্তি।

২০) ৬৪ বছর আগে, ওইদিনে

এই ক্রিকলফিল্ড স্টেডিয়াম সঙ্গে একটা আত্মিক যোগ রয়েছে ভারতীয় ফুটবল প্রেমীদের

ঠিক স্টেডিয়াম নয়, মাঠ বলতে পারেন। ওঁরা বলেন, ক্রিকলফিল্ড স্টেডিয়াম। ইলফোর্ড ফুটবল ক্লাবের মাঠ সেটা। ২০১২-র অলিম্পিক কভার করতে গিয়ে ঠিক ৩১ জুলাই ওই মাঠটা খুঁজে বার করেছিলাম। হঠাৎ ৩১ জুলাই বা কেন! আসলে এই মাঠটার সঙ্গে ভারতীয় ফুটবল প্রেমীদের একটা আত্মিক যোগ থেকে থাকবে। ১৯৪৮-এ লন্ডন অলিম্পিকে খালি পায়ে ফুটবল খেলে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন টি আও, শৈলেন মান্না, আমেদ খানরা। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ২-১ গোলে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল অলিম্পিক থেকে। সেদিন দুটো পেনাল্টিও মিস করেন ভারতীয়রা। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলের লোকগাথায় থেকে গেছে সেই ম্যাচটা। এমনকি শৈলেন মান্নাদের ফুটবল দেখে ব্রিটেনের রানিও নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, খালি পায়ে কীভাবে এত ভাল ফুটবল খেলো তোমরা! আর সেই ম্যাচটা হয়েছিল ইলফোর্ড ফুটবল ক্লাবের ওই মাঠে! হ্যাঁ, ওই ৩১ জুলাই তারিখেই। অদ্ভূত একটা অনুভূতি হচ্ছিল সেদিন ওই মাঠটায় দাঁড়িয়ে। ওইদিক থেকে হয়তো নেমেছিলেন বজ্রভেলু,ভরদবাজ, মহাবীর প্রসাদরা। ওই পেনাল্টি বক্সে দাঁড়িয়েই হয়ত পেনাল্টি থেকে গোল করার সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেছিলেন মান্না, মহাবীর প্রসাদ।

এই মাঠেই অলিম্পিক সেমিফাইনালে ভারত খেলেছিল ফ্রান্সের বিরুদ্ধে

বিশ্বাস করুন, সেদিন গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। মাঠের ঠিক পাশেই একটা বাড়িতে দেখলাম, বাঁকুড়ার পোড়া মাটির ঘোড়া রাখে আছে। বুঝলাম, বাঙালি পরিবার। নক করতেই বুঝলাম, অনুমান ঠিক। মানসী পুরকায়স্থ আর তাঁর পরিবারের সঙ্গে আলাপ সেখানেই। মানসীদি প্রচণ্ড খুশি বিষয়টা জেনে। ‘জানেন, এবার থেকে রোজ একবার মাঠটার দিকে তাকাব। আমাদের শৈলেন মান্নারা এই মাঠে খেলে গেছেন। দেশের সঙ্গে যোগাযোগের এর চেয়ে আর ভাল কী হতে পারে!’ এক্সট্রাটাইমে স্টোরিটা ওই ৩১ জুলাই-ই সম্প্রচার করা হয়। হয়ত, নিউজ ভ্যালুর জায়গা থেকে বিরাট কোন প্রাপ্তি নয়, কিন্তু আবেগের জায়গা থেকে? আমার স্মৃতিতে থেকে যাবে আজীবন।

২১) রায়চকে রুডি

কলকাতার এক খবরের কাগজের ঘনিষ্ঠ সম্পাদক দিয়েছিলেন খবরটা। ‘কাল রাজীব প্রতাপ রুডি আসছেন কলকাতায়। না সরকারকে কিছু জানানো হয়নি। যাবেন রায়চকের একটা হোটেলে। ধরতে পারো কিনা দেখো।’ সকাল সকাল আমিও রায়চকের পথে। রুডি তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। সরকারি প্রটোকল হল, যে কোন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সমস্ত মুভমেন্ট জানাতে হবে লোকাল পুলিশকেও। অবাক করে, রুডির খবর জানানো হয়নি কাউকেই। হোটেল কর্তৃপক্ষ শুরুতেই অস্বীকার করলেন রুডি সেখানে উঠেছেন বলে। আমারও ধৈর্যের পরীক্ষা শুরু হল। লবিতে বসতে দেওয়া হল না। বাইরে গিয়ে গাড়িতে বসে থাকলাম। বিকেলবেলা রুডি নামলেন। ক্যামেরা আর বুম দেখেই ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিলেন। কলকাতা থেকে অত দূরেও যে ধরা পড়ে যাবেন, ভাবেননি। কিছু জরুরি মিটিং ছিল বলে গাড়িতে উঠে প্রায় পালালেন। স্টোরিটা দেখানো হয়েছিল খোঁজখবরে। আরও কিছু ইনপুটস সহ। যাঁর আমন্ত্রণে এসেছিলেন রুডি, সেই ব্যবসায়ীকেও ধরা হয়েছিল। একটা সময় খোঁজখবর এরকম বহু ভাল ভাল নিউজ ব্রেক করেছে। সময়টাও অনেক সহনশীল ছিল। এখন এসব চললে কী হত, শুধু ঈশ্বর বলতে পারবেন।

২২) ব্রাজিল টিমের অন্দরমহলে

২০১৮ বিশ্বকাপে সোচির এই সুইসোতেলে থেকেছিল ব্রাজিল ফুটবল দল

যে কোন বিশ্বকাপের আগে অংশগ্রহনকারী দেশ তাদের বেসক্যাম্পটা ঠিক করে নেয়। অর্থাৎ গোটা টুর্নামেন্টটা কোথায় থাকবে, অনুশীলন করবে। ওই বেসক্যাম্প থেকেই সাধারণত তারা বিভিন্ন ভেন্যুতে খেলতে যায়, খেলা শেষে আবার ফিরেও আসে। ২০১৮-র বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বেস ক্যাম্প ছিল সোচি বলে একটা জায়গায়। রাশিয়ার একেবারে দক্ষিণে এই শহর, পাশেই কৃষ্ণসাগর। সোচির সুইসোতেলে টিম থাকছিল, পাশেই একটা ছোট স্টেডিয়ামে প্র্যাক্টিস করছিল। সোচি পৌঁছে গেছিলাম ব্রাজিল প্র্যাক্টিস শুরু করার একদিন আগেই। সুইসোতেলের বাইরে দেখলাম ব্রাজিলিয়ান সমর্থকদের ভিড়। পৌঁছে গেছে ব্রাজিল টিম। সিকিউরিটি বেশ টাইট। আমার সঙ্গে প্রতিদিন কাগজের দুলাল দে।

হলুদ-সবুজ বেলুন, ফুটবলে সাজানো হোটেলের লবি

সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হল, ভিতরে একবার ঢুঁ মারলে কী হয়! বড়জোর গেট থেকে ফিরিয়ে দেবে। সুইসোতেলে প্রধান দরজা থেকে হোটেলের ভিতরের দরজা অনেকটা হেঁটে যেতে হয়। তাই করলাম। মেইন গেটের আগে গলা থেকে মিডিয়া কার্ডগুলো খুলে নিলাম। সাধারণ কাস্টমার হিসেবে গেলে বরং আটকানোর চান্স কম। তাই করলাম। সিকিউরিটি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমরা ভিতরে। হোটেলের ম্যাপ জানিনা, কোথায় কী কিছু জানিনা। দুলালকে বললাম, ঢুকেই লিফটের দিকে এগিয়ে চল। কফি শপের ফ্লোরটা অন্তত কেউ আটকাবে না। থার্ড ফ্লোরের ওপর কফিশপ। সেখানেই গিয়ে বসলাম একটা কফি নিয়ে। ব্রাজিল টিমের লাঞ্চ আর ডিনারের ব্যবস্থা ছিল সেখানেই। দারুণ করে সাজানো হয়েছিল জায়গাটা। পাশেই হোটেলের সুইমিং পুল। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা সাঁতার কাটতে আসছিলেন এখানেই। পাশাপাশি দুটো উইং হোটেলের।

এই সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে আসতেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা

একটায় ফুটবলাররা থাকছিলেন, আর একটায় তাঁদের স্ত্রীরা। এক্সট্রাটাইমের ফেসবুক পেজে পুরোটা লাইভ করছিলাম। এই চত্বরে নিরাপত্তার কোন বাড়াবাড়ি নেই। বেশ ফ্রি ভাবেই কাজ করতে পারছিলাম। হোটেলের একজিকিউটিভ শেফ এলেন। তাঁর ইন্টারভিউ করলাম, ফুটবলাররা কী খাচ্ছেন, কী কী স্পেশাল ব্যবস্থা তাই নিয়ে। ব্রাজিল তার নিজস্ব শেফ নিয়েও এসেছিল। তবু প্রচুর দায়িত্ব ছিল সুইসোতেলের শেফেরও। লাইভ হওয়ার জন্য এক্সট্রাটাইমের দর্শকরা সরাসরি দেখছিলেন ব্রাজিলের টিম হোটেল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টেকনোলজি পরিবর্তন হয়ে যায়। দশ মিনিটের খেল-এর হয়ে যখন বিদেশ সফরগুলোয় যেতাম, ক্যাসেট পাঠাতে হত হয় ক্যুরিয়র কিংবা কোন চেনা মানুষের সঙ্গে ফ্লাইটে। এমন কত দিন হয়েছে, হায়দরাবাদ, দিল্লি কিংবা মুম্বই বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে লোকজনের হাতে পায়ে ধরেছি হ্যান্ড ব্যাগে ভরে ক্যাসেট কলকাতা পৌঁছে দেবার জন্য। বেশিরভাগ মানুষই রাজি হতেন না। তবু আমরা খবর টাটকা মানুষকে দেখানোর জন্য অমানুষিক চেষ্টা করে যেতাম। মনে আছে, জাকার্তা থেকে আশিয়ান কাপের ক্যাসেট আসত অন্তত ৫/৬ দিন পর। স্টোরির ভাবনায় তাই প্রতিদিন নিত্যনতুন ভাবনা জুড়তে হত, যাতে মানুষের প্রাসঙ্গিক লাগে। আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষকে লাইভ দেখানো যাচ্ছে সবটা। ভাবতে পারেন, মানুষ কলকাতায় নিজের বাড়িতে বসে ব্রাজিলিয়ান বেস ক্যাম্পের ভিতরটা লাইভ দেখছে। প্রথম যেবার আজকালে বিশ্বকাপ কভার করলাম ডেস্কে বসে, তখন কপি আসত ফ্যাক্সে। ফটো রোলগুলো আসত ক্যুরিয়রে। ২৫টা বছরে এই প্রযুক্তির বদলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাও কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু না বদলালে যে পিছিয়ে পড়তে হত।

২৩) পুলিশ বিদ্রোহ

দশ মিনিটের খেল আর খোঁজখবরের সময় সেটা। মাঝরাতেই ফিরছি অফিস থেকে। চিড়িয়ামোড়ের কাছে এসে বুঝতে পারলাম, সামনে কিছু একটা অশান্তি হচ্ছে। পাশের পুলিশ ব্যারাক থেকে পিলপিল করে লোক বেড়িয়ে আসছে বি টি রোডের ওপর। মুহূর্তের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়ে গেল বি টি রোড। কারা করলেন? রাজ্যের পুলিশরা। কল্পনা করুন পরিস্থিতিটা, যাঁদের ওপর দায়িত্ব থাকে অবরোধ তোলার, তাঁরাই করছেন পথ অবরোধ। কিন্তু কেন? যা শুনলাম, সেটা হল, ওদের ব্যারাকে থাকেন এমন একজন পুলিশ কর্মী এক অজানা জ্বরে মারা গেছেন তার একটু আগে। ব্যারাকগুলোর অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। যে কেউ অসুস্থ হয়ে যাবেন এখানে থাকলে। পুলিশকর্মীদের প্রতিবাদ সে নিয়েই। অফিস থেকে ক্যামেরা আনানোর ব্যবস্থা করলাম তখনই। বিক্ষোভের ছবি হল। কিন্তু আসল কারণ তো আরও গভীরে। পরদিন থেকেই আসল খোঁজখবর শুরু হল। ঠিক কী ছবি পুলিশ ব্যারাকগুলোর ভিতরে। সাধারণত ক্যামেরা নিয়ে পুলিশদের থাকার জায়গা অবধি যাওয়া যায়না। তবু লুকিয়ে বেশ কয়েকটা ব্যারাকের ছবি তুললাম। কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম আলিপুর পুলিশ লাইনে। পুলিশ থেকে ধরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ওদের এক অফিসারের কাছে। অভিজ্ঞতা বলছিল, এরা ক্যাসেট চেক করে দেখতে চাইবে, কী কী ছবি আমরা তুলেছি, কারণ প্রতিটা পুলিশ ব্যারাকই অত্যন্ত নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর। ক্যামেরাম্যানকে বললাম, চলতি ক্যাসেটটা বদলে অন্য ক্যাসেট ঢুকিয়ে নিতে ক্যামেরায়। কিন্তু আসল ক্যাসেটটা রাখব কোথায়! জুতোর ফিতে বাঁধার ভান করে ক্যাসেটটা ঢোকালাম মোজার ভিতরে। কিন্তু দীর্ঘ ব্যবহারে সেগুলোর ইলাস্টিকও গেছিল ‘লুজ’ হয়ে। ফলে আমাকে হাঁটতে হচ্ছিল একটা পা টেনে টেনে। অফিসারের রুমে ঢোকার পর তিনি জিজ্ঞেসও করলেন, কী হয়েছে পায়ে? বললাম, অফিসে ফুটবল খেলতে গিয়ে লেগেছে! তারপর প্রশ্ন শুরু হল? ভিতরে কী করছিলেন? বললাম, কিছু ছবি করার ছিল। কিন্তু তার আগেই আপনি ডেকে পাঠালেন। বললেন, দেখান আপনার ক্যামেরা। ক্যামেরাম্যান অম্লান বদনে দেখিয়ে দিল পুরোনো ক্যাসেটে অন্যকিছুর শ্যুটিং। ভদ্রলোক ছেড়ে দিলেন। বললেন, অনুমতি ছাড়া এখানে শ্যুটিং হবে না। আমি বললাম, ঠিক আছে। কারণ, আসল ছবি তো তখন আমার মোজার ভিতরে। আবার পা টেনে টেনে বেড়িয়ে এলাম। খোঁজখবরে রাজ্যের পুলিশ বিদ্রোহ নিয়ে পরে বড় স্টোরি হয়। ধরা পরে যাবার আরও একটা ঘটনা এটা লেখার সময়ই মনে পড়ে গেল। সেটা ইস্টবেঙ্গলের ইলেকশন ইয়ার। পল্টু দাস গ্রুপ বেশ কিছু গোঁজ প্রার্থী দিল নির্বাচনে। তারমধ্যে একজন ফুটবল সচিব বাবু ভট্টাচার্যর রাজমিস্ত্রী গঙ্গাপ্রসাদ সিং। তাকে দমদম থেকে খুঁজে বার করে আজকাল অফিসে নিয়ে আসি, নতুন একটা কাজের প্রস্তাব দিয়ে। এসে তাঁকে নানা কিছু বুঝিয়ে ছবি তোলানো হয়। ইস্টবেঙ্গল ক্লাব নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। বেচারি সত্যি জানত না কিছু। মারাদোনার ছবি দেখে বলে, “ইয়ে আদমি তো বাবুসাহাব কা পাস আতে হ্যায়।” পরদিন বড় করে তাঁর ছবি দিয়ে স্টোরি বের হয় আজকালে। সেদিন সকালেই আরো একজন এরকম প্রার্থীর জন্য ঘুরছি জ’পুরের রাস্তায়। দেখি, আমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে সেই গঙ্গাপ্রসাদ। সে এই মারে তো সেই মারে। আমাকে ধরে নিয়ে গেল বাবু ভট্টাচার্য কাছে। বাবুদা তো খুব লজ্জিত, “কিছু মনে করবেন না ওর ব্যবহারে। ও বুঝতে পারেনি।” সে যাত্রায় রক্ষা পেলাম। গঙ্গাপ্রসাদ নিশ্চয়ই এখনও অবাক হয়ে ভাবে, বাবুসাহাব ওই লোকটাকে ছেড়ে দিয়েছিল কেন!!

২৪) পেলের বাড়ি

পেলের বাড়ির সামনে

সাও পাওলো থেকে ঘণ্টা পাঁচেক লাগল বাউরু যেতে। একটা অন্যরকম উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম নিজের মধ্যে। ছোটবেলা থেকে পেলের ছোটবেলার কত গল্প শোনা। সেই শান্তিপ্রিয় বন্দোপাধ্যায়ের বই, প্রতিটা বাঙালি বোধহয় একসময় নিজের স্বপ্নকে খুঁজে বেড়িয়েছেন বাতাবি লেবু আর কাগজের বলের মাঝে। হাতে ছিল পেলের আত্মজীবনী ‘মাই লাইফ অ্যান্ড দ্য বিউটিফুল গেম’। ব্রাজিল আসার আগে থেকে পাতা উল্টেছি ওই বইয়ের। একটা অন্যরকমের রোমাঞ্চ যেন সবটার মধ্যে, শেষ অবধি আমি যে পেলের পাড়ায়। যদিও গুগল ম্যাপ দেখে রুয়া সেভেন সেটেম্ব্রো খুঁজে বার করতে খানিকটা সময় লাগল। ওটাই পেলের বাড়ির রাস্তা। ওখানেই মোজার মধ্যে কাগজ ভরে শুরু হয়েছিল ফুটবল। পেলের প্রথম ক্লাবও তাই সেভেন সেটেম্ব্রো ক্লাব। পাড়ার ছেলেরা মিলে তৈরি করেছিলেন। সেটেম্ব্রো মানে সেপ্টেম্বর। ওই রাস্তার ৪-১ সি বাড়িটায় ছোটবেলা কেটেছিল পেলের। আমাদের গাড়ি থামল ওই বাড়িটার সামনেই। গোটা রাস্তা কিংবা বাড়িটাকে আদৌ বস্তি বলা যাবে না। এটা ঠিক যে প্রচণ্ড দারিদ্রর মধ্যে শৈশব কাটিয়েছিলেন পেলে, কিন্তু বাড়ি, পাড়ার সবটায় মধ্যবিত্তয়ানার ছাপটা স্পষ্ট।

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পেলের বাড়ির বারান্দায় জমেছে স্তূপীকৃত পাতা

দোতলা বাড়িটা এখন বন্ধ। কোনও যে রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি দীর্ঘদিন, তা দেখলেই বোঝা যায়। ঘরের সিলিং খুলে খুলে পড়ছে। উঠোন, বারান্দা সবটায় স্তূপীকৃত পাতা। অথচ এই বাড়িটা সত্যি এই শহরের গর্বের স্মারক হতে পারত। বাড়ি থেকে গেলাম পেলের একেবারে ছোটবেলার স্কুল এরনেস্টো মন্টেতে। কয়েক বছর এখানে পড়েছিলেন পেলে। পরে অভাবের তাড়নায় স্কুল ছেড়ে দিতে হয়। একটা নোটিশ বোর্ডে পেলের ছোটবেলার একটা ছবি ঝুলছে দেখলাম, এছাড়া এখানেও পেলের কোন স্মৃতি নেই। গেলাম নোরোয়েস্টে ফুটবল স্টেডিয়ামে। পেলের বাবা ডনডিনহো ফুটবল খেলতেন বাউরু অ্যাথলেটিক ক্লাবে।

এই নোরোয়েস্টে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসতেন পেলে

পেলেও ছোটবেলায় খেলেছেন বাউরুতে। তাঁদের প্রতিপক্ষ ছিল এই নোরোয়েস্টে ক্লাব। বাউরু ক্লাব ১৯৬০ সালে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু নোরোয়েস্টে স্টেডিয়ামটা এখনও একইরকম আছে। এখানে খেলা দেখতে আসতেন পেলে। বাবার খেলা দেখে এক সমর্থক কটূক্তি করায় মারপিটও করেছিলেন একজনের সঙ্গে। ওখান থেকে গেছিলাম নোরোয়েস্টে স্টেশনে। এখন বন্ধ সেই স্টেশন, কিন্তু একটা গোটা বাউরুটাই জমজমাট রেলওয়ে শহর ছিল। পেলের ছোটবেলার ফুটবল চলেছে রেল লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়াগন থেকে মাল সরিয়ে। কিন্তু দারিদ্র একসময় এমন চরম জায়গায় ছিল যে ওই নোরোয়েস্টে স্টেশনে বুট পোলিশ করতে যেতে হয় পেলেকে। বন্ধ নোরোয়েস্টে স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, একটা রূপকথাকে জীবন্ত হতে দেখছি চোখের সামনে। তবে বাউরু দেখে হতাশ হয়েছিলাম খুব। এই শহরের বিশ্বখ্যাত সন্তানের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে কোন ভূমিকা নেয়নি এই শহরের মানুষজন। অথচ ১৯৫৮-তে ব্রাজিলকে বিশ্বজয়ী করে পেলে যখন ফিরলেন বাউরুতে, এখানেই নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। কে জানে, কেন পেলেকে ভুলে গেল বাউরু! কোন অভিমানে!

কলকাতায় পেলের হাতে তুলে দিলাম বাউরুর ওর সমস্ত স্মৃতির কোলাজ

২০১৫-তে দ্বিতীয়বারের জন্য যখন পেলে এলেন এই শহরে, নিউটাউনের এক হোটেলে মিট করেছিলাম । সঙ্গে নিয়ে গেছিলাম বাউরুর ওর সমস্ত স্মৃতির কোলাজ, একটা ফটো ফ্রেমে। ছবিটা হাতে নিয়ে এক মুহূর্ত চুপ করে থাক্লেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই ছবিগুলো তুমি কোথায় পেলে?” আমি বললাম, “আমি ব্রাজিল বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে আপনার ছোটবেলার বাড়ি দেখে এসেছি।” হাসলেন। নিজের সেক্রেটারিকে ফোটো ফ্রেমটা দিয়ে বললেন, “এটা রেখে দাও। এটা আমি নিয়ে যেতে চাই।” একজন ক্রীড়া সাংবাদিকের জীবনে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!

২৫) রাহুলকে খুঁজে পাওয়া

এখন রাহুল

খেলার বাইরের স্টোরি। কিন্তু খেলার মতই উদ্বেগে আর টেনশনে ভরপুর। দশ মিনিটের খেল দেখাশোনা করি তখন। মাঝেমাঝে খোঁজখবরের স্টোরিও করি। সেদিন বিকেলে শ্রীরামপুর থেকে কেউ ফোনটা করেছিলেন। বললেন, “আমি একটা ডাই ক্লিনিংয়ের দোকান চালাই। আমার এখানে জামা কাপড় কাচাকাচি করে, এমন এক ভদ্রলোক এসে বলছিলেন, ওদের গ্রামে নাকি একটা বাচ্চা ছেলে এসে আছে, যে ওই গ্রামের নয়।” ভদ্রলোকের কাছে ঠিকানা নিয়ে পরদিনই রওনা হয়ে গেলাম। হুগলির খুব ভিতরে একটা গ্রাম। নামটা কাপাসারিয়া। বেগমপুরের কাছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গ্রামটায় পৌঁছাই, ছেলেটাকে খুঁজে বার করি। কিন্তু মুসকিলটা ছিল, গ্রামের যে পরিবারটায় ও থাকছিল, সেই আব্দুল রশিদ আর তার স্ত্রী ওকে ছাড়তে চাইছিল না। মাটির একটা বাড়িতে ওদের সঙ্গেই থাকছিল ও। ওরা বলছিল, ওদের বড় ছেলে ও। প্রায় জোর করেই ছেলেটাকে নিয়ে চন্ডীতলা থানায় যাই, অভিযোগ লেখাই। গাজিয়াবাদের ছেলে ছিল। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। হাওড়াগামী একটা ট্রেনে চেপে চলে আসে এখানে। তারপর ঘটনাচক্রে এই গ্রামে। ছেলেটার কাছেই বাড়ির ঠিকানা জোগাড় হয়। আমার দিল্লির এক বন্ধুর মাধ্যমে ওর বাবার সঙ্গে তখনই যোগাযোগ হয়। তিনি সে রাতেই কলকাতায় আসার ট্রেনের টিকিট কাটেন। একদিন পর আবার আমরা যাই ওই গ্রামে। সঙ্গে খোঁজখবরের সেই সময়ের উপস্থাপক কৃষ্ণকিশোর মুখার্জি আর ছেলেটির বাবা। আমাদের ক্যামেরার সামনেই ছেলেকে ফিরে পান বাবা। জানিনা কোনও রিয়েলিটির শোয়ের মঞ্চেও এইরকম মুহূর্ত জীবন্ত ধরা দিয়েছে কিনা, কিন্তু আমাদের সেদিনের এপিসোডে সেটাই হয়েছিল।

তারপর প্রায় একযুগ কেটে গেছে, ভুলেও গেছিলাম ওই ছেলেটার কথা। হঠাৎ একদিন গ্রেমাইন্ডের মেইলে দেখি কেউ একজন লিখেছেন, “আমার নাম রাহুল গুপ্তা। আমি দিল্লিতে থাকি। আমি অনিলাভ চ্যাটার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই। কীভাবে সম্ভব?” ফোন নম্বর দেওয়াতে ফোন এল, “আঙ্কেল আমি রাহুল। যাকে আপনি উদ্ধার করে বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমি এখন এমসিএ করছি। দিল্লিতে একটা ভাল চাকরিও করি। থ্যাঙ্ক ইউ। সেদিন আপনি না উদ্ধার করলে কী হত জানিনা। আমার এই নতুন জীবনটা আজ আপনার জন্য।” কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। সত্যিই, সাংবাদিকতা কতভাবে জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করায়। এই লেখাটা লেখার আগে আবার দেখছিলাম রাহুলের ফেসবুক প্রোফাইল। দেখলাম, এখন সিঙ্গাপুরে কাজ করছে। সুপ্রতিষ্ঠিত। ভাবছিলাম, কোথায় হুগলির সেই প্রত্যন্ত গ্রাম আর কোথায় সিঙ্গাপুর। ভাগ্যিস সেদিন অজানা ওই লোকটার ফোনটা এসেছিল!!

২৫ বছর তো ২৫টা স্টোরিতে শেষ হয়না। কত স্মৃতি ফিকে হয়েছে, আরো কত স্মৃতি লিখতে না পারলেও মনে ঝলমল করছে। লাহোরেই রেশমাজির সঙ্গে দেখা হওয়া। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের অফিসে বসে গান শুনেছিলাম, লম্বি জুদাই। ফয়সালাবাদের নুসরত ফতে আলি খানের পুরনো হাভেলি দেখে আসার পর রহত ফতে আলি খানের নতুন বাড়িতে বসে শুনে আসা গান, তুঝে দেখ দেখ কে শোনা, তুঝে দেখকে জাগনা। গানটা গেয়ে টিভি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ওস্তাদ বলেছিলেন, শচীনের জন্য গাইলাম এটা। পেশোয়ারে প্রচুর খুঁজে এক পুরনো মহল্লা থেকে আবিষ্কার করেছিলাম দিলীপ কুমারের বাড়ি। গেছিলাম শাহরুখ খানের জ্যেঠার বাড়িতেও। ছোটবেলায় যে বাড়িতে বেশ কিছু সময় কাটে শাহরুখের। মনে পড়ছে, ভারতীয় দলে কামব্যাক করার পর ইডেন থেকে সৌরভ গাঙ্গুলির নিজের গাড়িতে তুলে নেওয়া। ইডেনে সাংবাদিক সম্মেলন করার পর বাড়ির খাবার টেবিলে বসে প্রথম সাক্ষাৎকারটা আমাকেই দিয়েছিলেন। কিংবা জ্যোতির্ময়ী শিকদারের স্বামী অবতার সিং-এর বেআইনি বার নিয়ে স্টোরি করার পর ক্রমাগত টেলিফোনিক হুমকির কথাও। টাটকা মনে আছে ইস্টবেঙ্গলের আশিয়ান কাপ জয়ের প্রতিটা মুহূর্ত।

ফাইনালে বেক তেরো সাসানাকে হারিয়ে লাল হলুদ যখন গেলেরো বুং কর্ন স্টেডিয়াম থেকে হোটেলে ফিরছে, টিম বাসে চেপে পড়েছিলাম। গোটা টিম নাচছিল ‘মাছের রাজা ইলিশ’ গানের সঙ্গে। ক্যামেরাম্যান সুবীর দেবনাথ ধরে রাখছিল প্রতিটা মুহূর্ত। এর উল্টো ছবি ছিল সেদিন ডেম্পোর টিম বাসে। ব্যাঙ্গালোরে ফেডারেশন কাপের ম্যাচ। একটু আগে জুনিয়রের নিথর দেহটা নিয়ে যাওয়া হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সে। ম্যাচ শেষ হতেই টিম বাসে উঠে পড়লেন ডেম্পোর ফুটবলাররা। সেই বাসেই ছিলাম আমি। বাস চলতে চলতেই খবর এল জুনিয়র নেই। সেদিন সতীর্থ ফুটবলারদের কান্না, আর্তনাদ চোখের সামনে দেখেছিলাম। ওদের কারও কারও জার্সি তখন হয়ত জুনিয়রের ঘাম মাখা। হায়দ্রাবাদে একবার খুঁজে বের করেছিলাম মহম্মদ আকবরকে। ওই নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে। তখনও মোবাইল ফোন নেই। কলকাতা থেকে বহুদূরে তখন বিস্মৃত আকবর। ওকে খুঁজে পেয়েছিলাম চারমিনারের সামনে একটা শাড়ির দোকানে। তখন শাড়ি বিক্রি করেন আকবর। সেবার খুঁজে বার করেছিলাম ইস্টবেঙ্গলের পঞ্চপান্ডবের ধনরাজকে। সেকেন্দ্রাবাদের বাইরে একটা গ্রাম। ওই গ্রাম থেকেই উঠে এসেছিলেন ধনরাজ, থঙ্গরাজ, পুঙ্গব কান্ননরা। গ্রামটার নাম মনে নেই। এসব পেপার কাটিং গুলো সংগ্রহে রাখতেন আমার বাবা। তিনিও কয়েক মাস আগে চলে গেছেন চিরঘুমের দেশে। আজ থাকলে এই লেখাটা খুব আগ্রহ ভরে পড়তেন, আমি নিশ্চিত। মতামত দিতেন। আমার বইপত্র, তথ্যের সমস্ত তথ্যের রেডি রেফারেন্স যে তিনিই। প্রতিটা মুহূর্ত মিস করতে হয় তাঁকে। কিন্তু কী করব। পথ চলতে চলতে তো কিছু মানুষের ভরসার হাতটা ছাড়াও হয়ে যায় মাঝে মাঝে। আবার নিজেকে গুছিয়ে নিতে হয়। চলতে চলতে নিজের মত করে।

দাদাগিরির সেটে সৌরভের সঙ্গে

কিংবা দাদাগিরি তৈরি করার প্রথম বছরের প্রতিটা দিন। প্রতিটা মুহূর্ত। নাগপুরের জীবনের শেষ টেস্টের সময় সৌরভকে যখন বলেছিলাম, ওর প্রশ্ন ছিল,’আমি কি পারব? ঠিক আছে, যদি কৌন বনেগা ক্রোড়পতি মত ক্যুইজ শো হয়, তাহলে করতে পারি।’ তারপর টানা প্রথম ছয় মাস লেগেছিল আমাদের শোয়ের ফরম্যাট, প্রি প্রোডাকশন রেডি করতে। অমানুষিক পরিশ্রম ছিল দাদাগিরি প্রথম বছরটায়।

আমার পত্রিকা হ্যাংলা হেঁশেলের বয়েসও হয়ে গেল ৭ বছরেরও বেশি। একটা নতুন জগতকে চিনেছি, উপলব্ধি করেছি খাবারের পত্রিকা দিয়ে। এই জগতেরও প্রচুর মানুষকে চিনেছি, জেনেছি। হ্যাংলার সম্পাদকীয় লেখার জন্য ফুড এক্সপ্লোর করেছি পৃথিবীর নানা প্রান্তে। কত ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে।

একজন সাংবাদিকের জীবনে এগুলো নিশ্চয়ই প্রাপ্তির জায়গা। আজীবন স্মৃতির মনিকোঠায় থেকে যাবে এই সোনার সময়। তবে আমার ব্যক্তিগত প্রাপ্তির জায়গা বোধহয় আরও দু’একটা আছে। প্রথমত, আমার টিম। একটা সোনার টিম দশ মিনিটের খেল থেকে পাশে ছিল আমার। এদের মধ্যে কয়েকজন এখনও আমার সঙ্গেই থেকে গেছে প্রায় দুই দশক ধরে। এবং নিজের নিজের জায়গায় চিনিয়ে দিয়েছে নিজেদের উপস্থিতি। দেবাশিস সেন কিংবা গোপাল রায়রা ক্রীড়া সাংবাদিকতায় নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে নিজেদের মুন্সিয়ানায়। দেবাশিস, সবার পরিচিত মামা ভারতীয় ক্রিকেট সার্কিটে খুবই পরিচিত মুখ। তপন নস্কর! দক্ষিণ ২৪ পরগনার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছিল ছোট্ট একটা ক্যামেরা নিয়ে। এখন পৃথিবীর যে খেলার লাইভ টেলিকাস্ট হোক, তপনকে দাঁড় করিয়ে দিন যে কোন ক্যামেরায়, সেরা আউটপুট দিয়ে চলে আসবে। ভারতের যে কোন প্রান্ত থেকে যে কোন খেলায় লাইভ প্রোডাকশন করে চলে আসবে পবিত্র। কিংবা আমার সেই টিমের বাকিরা। সুপ্রিয় রায় কর্মকার এখন নিউজ টাইম টিভির প্রধান। কুন্তল চক্রবর্তী এবিপি নেটওয়ার্কে এক নম্বর ক্রিকেট সাংবাদিক। আমাদের এডিটর অনিরুদ্ধ সরকার এই মুহূর্তে ওই নেটওয়ার্কেই গ্রাফিক্স হেড। বিশ্বাস করুন, গোপাল বাদে এদের সবার শুরু আমার সঙ্গে। কেউ কলেজ শেষ করে, কেউ কলেজে পড়তে পড়তেই শুরু করে দিয়েছে কাজ। ওই ছোট্ট একটা দশ মিনিট সময়ের খেল বুলেটিন থেকে। বাকি আরও কত ছেলে মেয়ে কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে। এটাই উত্তরাধিকার, এই লেগাসিটাই যে কোনও মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। এদের প্রতিটা ছেলে মেয়ে আমাকে গর্বিত করে ভাল কিছু করলে।

তবে দিন দিন কঠিন হয়ে যাবে ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাজ। অন্তত যাঁরা মাঠে নেমে, হাতে কলমে কাজটা করতে চান, তাদের পক্ষে নিজেদের আলাদা করে চেনানোর কাজটা কঠিন হবে। কারণ আমাদের এই সময়ে প্রতিটা ক্রীড়াবিদের সমস্ত আপডেট দর্শকরা, পাঠকরা পেয়ে যাচ্ছেন তাঁদের ট্যুইটার কিংবা ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে। মেইন স্ট্রিম মিডিয়ার পরোয়া করছেন না তাঁরা। সাংবাদিকরা তাহলে কী লিখবে, কী দেখাবে? ডিজিটাল মিডিয়ায় আমাদের তাই প্রতিদিন যুদ্ধ করতে হচ্ছে কনটেন্ট নিয়ে। নতুন কী দিতে পারি, নতুন কীভাবে দর্শকদের এনগেজ রাখা যায় তাই নিয়ে চুল ছিঁড়তে হচ্ছে। লক্ষ্য করুন এখন বেশিরভাগ সংবাদপত্র, ওয়েবসাইটে দেখবেন, খেলোয়াড়দের সোশ্যাল মিডিয়াকে উদ্ধৃত করে কিছু কপি, ছবি। তাই ডিজিটাল মিডিয়ায় এখন আমরা যাঁরা কাজ করছি তাদের কাছে সবটাই চ্যালেঞ্জিং। যখন শুরু করেছিলাম, তখন মোবাইল ফোনও ছিল না। কোন খেলোয়াড়ের এর কাছে পৌঁছানোর রাস্তা একটাই, তাঁকে খুঁজে বার কর। আজ এতটাই বদল যে তাঁর বাড়ির অন্দরমহল দেখিয়ে দেবেন এক খেলোয়াড়।

আর অবশ্যই বাংলার ফুটবল। গ্রেমাইন্ড কমিউনিকেশনের হয়ে আমরা প্রায় হাজারেরও বেশি ফুটবল ম্যাচ প্রোডাকশন করেছি। ২০০৬-এ অনিরুদ্ধ গুহ রায়কে নিয়ে নিজের কোম্পানি শুরু করলাম যখন, কলকাতা ফুটবল লিগের সম্প্রচার বিশ বাঁও জলে। ২৪ ঘন্টা চ্যানেলের অভীক দত্তর কাছে নিয়ে গেলাম তখনকার আইএফ সচিব সুব্রত দত্তকে। অভীকদা বললেন, ‘ম্যাচ দেখাতে পারি। কিন্তু প্রোডাকশন খরচ দিতে পারব না।’ অনিরুদ্ধদা বলল, ‘ আমরা ইনভেস্ট করব।’ সেই শুরু। তারপর থেকে চলছে। বাংলার ফুটবল, দেশের ফুটবল আমাদের সম্প্রচারে পৌঁছে গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে। মেসির কলকাতায় ম্যাচ থেকে প্রিওয়ার্ল্ড কাপ কিংবা আই লিগ, ফেডারেশন কাপ সবকিছু সম্প্রচারের অভিজ্ঞতা রয়েছে আমাদের।

জানিনা, স্পোর্টস বুলেটিন কিংবা বাংলার ফুটবলের লাইভ কভারেজ কতটা সাহায্য করেছে এই রাজ্যের ফুটবলকে, সেটা এতগুলো বছর ধরে যাঁরা আমাকে ফলো করছেন তাঁরা ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু আমার নিজের কয়েকটা ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি আছে। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের কয়েকটা কালজয়ী গানের সঙ্গে আমার নিজের অনেকটা অবদান আছে। না, লিরিসিস্ট, কম্পোজার কিংবা গায়ক হিসেবে নয়, কিন্তু এই গানগুলোর ভাবনার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে। এখনও যখন কোন মাঠে গিয়ে শুনি বাজছে ‘আমাদের সূর্য মেরুণ’, মনে পড়ে যায় এগারো সিনেমার গান রেকর্ডিং এর সময়টা। সিনেমার মূল ভাবনায় ছিল না গানটা।

এগারো’র শুটিংয়ে

আমিই মিউজিক ডিরেক্টর ময়ূখ মৈনাককে বলি, মোহনবাগান নিয়ে একটা থিম সং যদি রাখা যায়। তারপরই ওই কালজয়ী গান লিখে ফেলেন সুমন্ত্র চৌধুরি। কালপুরুষের ‘মাছের রাজা ইলিশ’ গানটা দশ মিনিটের খেল থেকে প্রোডিউস করেছিলাম, ইস্টবেঙ্গল পাঁচে পাঁচ ট্রফি জেতার পর। এবারও ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের গান। সুরকার অরিন্দম এর আগে অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতার ‘ফাটাফাটি ফুটবল’ গান বানিয়ে মন জয় করে নিয়েছিল সবার। ইস্টবেঙ্গল কর্তা দেবব্রত সরকারের অনুরোধে অরিন্দমকে নিয়ে এলাম তাঁর কাছে। তারপর অরিজিত সিং। যে সময় এই গানের কথা হচ্ছে, অরিজিত প্রচণ্ড ব্যস্ত অন্য রেকর্ডিং নিয়ে। কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছে না। প্রায় যুদ্ধ করেই ওকে শেষ অবধি রাজি করানো, একটু রেগেও গেছিল। অবশ্য সে সব রাগ অভিমান ঠিক হতে বেশি সময়ও নেয় না।

অরিজিত সিং ও সৌরভের সঙ্গে

সেই ২০০৫ থেকে সম্পর্ক। এক্সট্রাটাইমের সমস্ত গান এক সময় ওর কম্পোজ করা। তখন অরিজিত সিং সবে ওর ভারত জয়ের দৌড়টার স্টার্টিং লাইনে। আর সেই ভারতখ্যাত অরিজিতই গাইল লাল হলুদের শতবর্ষের গান, “একশো বছর ধরে মাঠ কাঁপাচ্ছে যে দল”। কলকাতা ময়দানে যতদিন এই গানগুলো বাজবে, ততদিন আমি আছি। আর গানগুলো বোধহয় ইতিমধ্যেই কালজয় করে নিয়েছে। তাই এই ভাললাগাটা জীবনের শেষদিন অবধিই বোধহয় থাকবে আমার। অবসরের পরও কোন বিকেলে, কোন এক ফুটবল স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে যখন কানে আসবে এই গানগুলো, স্মৃতিতে ফিরে আসবে অনেক অনেক কথা।

এসব নিয়েই কেটে গেল ২৫ টা বছর। বাংলা খেলাধূলারও একটা অধ্যায়। সাংবাদিকদের কাজের তো কোন আর্কাইভ হয়না, হতেও পারেনা। বড় জোড় লেখা যেতে পারে বই। কিন্তু তাতে প্রতিদিনের খবরগুলো তুলে রাখবেন কী করে। এই লেখাটা লিখে ফেললাম ওই ভাবনা থেকেই। যদি থেকে যায় কাজগুলো। আর ওই যে বললাম, এগুলো পড়ে টাটুম আর চই যদি একবারের জন্যও ভাবে, ওদের বাবা মন দিয়ে, সততার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করে এসেছে, তাহলেই পুরো জার্নিটা বোধহয় সফল হয়।

এতগুলো বছর ধরে যাঁরা পাশে থাকলেন, সাহস যোগালেন তাঁদের সবাইকে আজ প্রণাম আর কৃতজ্ঞতা।

সবাই ভাল থাকবেন। সুস্থ থাকবেন।

33 thoughts on “২৫ বছরের জার্নি | অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়

  1. Knowing him well for so many years now…must declare that he is certainly a most talented & diversified Journalist who has made his mark through sheer hard work intertwined with sharp intelligence !!
    Wish Anilava greater success in the years to come !!

  2. Ekebare pore phelechi sonta. Darun anobodya. Tumi boyose Choto holeo Tomar ei sttrugle ke ami ki hits holeo jani aar respect kori 100 percent. Tumi Sidhu ekjon success full sports journalist nao, as a human being Tumi oneker ka he inspiretion, amar kache to oboshoi. Aar Tomar lekha automeic porer line e nie jay. Please be happy and stay well. LOVE………

  3. Tomar 25 bochorer onek ojana tottho jante parlam, bhalo laglo. Agami 25 bochorer jonno subhechcha roilo, aeibhabei egiye jao.

  4. তোর লেখার টান! একবারেই পড়ে ফেললাম! অনেকগুলোই চেনা স্টোরি, বিশেষত যেগুলো প্রিন্টে। বরাবর তোর অন্যরকম স্টোরির দিকে ঝোঁক। আর যেটা উপরি, চমৎকার লেখা। চিমা শেষ ম্যাচে লাল কার্ড দেখার পরও স্টোরি করেছিলি, মনে আছে। বিশ্বনাথন আনন্দের বই, চেন্নাই গিয়ে… জাস্ট মনে পড়ল… শারদীয়া খেলায় তোর লেখাটা পড়ছিলাম, পুজোর ছুটিতে ট্রেনে জলপাইগুড়ি যাওয়ার পথে। রাতে নিস্তব্ধ ট্রেন, আমি নিরুপদ্রব পড়ে চলেছি, কখন চোখ ভিজে গিয়েছে, জানি না…:)
    আমার বরাবরই মনে হয়েছে, ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মিডিয়ার লাভ হয়েছে, বাংলা প্রিন্ট মিডিয়ার অপূরণীয় ক্ষতি, অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়ের না-থাকা।
    লেখাটা ছাড়িস না, ছোট্ট অনুরোধ।
    খুব ভাল থাক। আরও ভাল কাজ অপেক্ষায়, আগামী ২৫ বছরে।
    অজস্র শুভেচ্ছা।

    1. thank you so much Kashida…thank you so much for inspiring all these years

      1. Anilava da porlam kub kub valo laglo. Amio ajkal er khela te liktam 2001 theke 2005. Tarpor onno profession a chole asechi. Kintu tomar 10 miniter khel theke fan chilam. Ajo achi. Tomar lekha pore onek kichu ojana kotha jante parlam. Tumi kub kub valo theko. Shuvo Nabobarso 1427.

      2. আমি কিন্তু উল্টোটাই সত্যি বলি… 😃
        আমার একটা দাবি রইল। এখানেই বলে রাখি। অন্যরাও কিছু বলতে পারে, সেই জন্য। সেটা হচ্ছে, লেখাটা পড়ার পর মনে হল, ‘২৫-এ ৫০!’ নামে দুর্দান্ত বই হতে পারে। আরও ২৫টা বেছেনে, মোট ৫০টা স্টোরির পেছনের গল্প। প্রতিটা গল্প ৮০০-১০০০ শব্দ। ৪০-৪৫ হাজার শব্দ এমনিই হয়ে যাবে। যে ভূমিকাটা এখানে দিয়েছিস আর যে উপসংহার, দুটো মিলিয়ে ৫০ হাজার বা তার বেশি শব্দ। প্রচুর ছবি তোর কাছেই আছে। তা ছাড়াও, প্রিন্ট-এ যে স্টোরিগুলো বেরিয়েছিল সেি কাগজের কাটিংগুলোর ছবি মাস্ট। তাতে হিস্টরিক্যাল অথেন্টিসিটি বাড়বে আরও। অনেক দিন পর কারও হাতে বইটা গেলে সে সেই কাটিংগুলোর ছবি দেখে বাড়তি অনুপ্রাণিত হবে। আমাদের এখানে এমন বই নেই, একটাও হয়নি। একেবারে অন্যরকম, দুর্দান্ত বই হতে পারে বলেই বিশ্বাস। আমি তো কিনবই, আমাদের মতো বহু পাঠকই কিনবে, আশা করি। ভেবে দেখিস … 😃😃

  5. Long and successful journey…… have been seeing you grow for atleast last 15years . The way you have diversified and steered yourself towards achievement speaks volumes about your hard work, grit, intelligence. Keep up the great job.

  6. কাশীদা একদম ঠিক কথা বলেছে। কাল শরীরটা ভাল ছিল না, তাও পুরোটা শেষ না করে থামতে পারিনি। হোয়াটস্যাপ-এ দুটো আবদার করছি, পারলে রেখো। আরেকটা অনুরোধ করব, তোমার লম্বা কেরিয়ারে প্রচুর আনটোল্ড স্টোরি তো আছেই আছে, সেগুলো তার সঙ্গে এই লেখায় যেগুলোর জায়গা হল না, সেগুলো নিয়ে একটা সিরিজ কি করা যায় না?

  7. What a journey sir…….best wishes for many more years to come with many such beautiful stories from you…..keep writing !

  8. Dada,
    You have been with us since our growing years as sports lovers. You candid style of reporting has always been the main attraction to your admirers like me. My sincere wish is always there for you and all your lovely family members. Stay blessed always, Dada ( Sir)

  9. ছোটবেলা থেকেই ভীষণ ট্যালেন্টটেড। খুব ইচ্ছা ছিল আই,এ,এস হোক। ও ইচ্ছা করলে হোতই। হলো সাংবাদিক। একটা অনুষ্ঠানে সম্বর্ধনা পাওয়ার পর বলল, তোমার কোন আফশোষ নেই তো?

  10. Anilava..First Congratulations on completing 25 yrs..Next target 50 yrs… Your writing has enriched us and entertained us for so many years..I just read your experiences of last 25 yrs..really engrossing and kept me engaged for last 2 hours..God Bless you and do continue to add value to the field of sports journalism for many many more years.

  11. অসাধারণ লিখেছেন দাদা।
    এত স্টোরির মাঝেও রাহুল গুপ্তার স্টোরি টা পোড়ে চোখে জল এসে গেল।
    একজন সৎ নিষ্ঠাবান সাংবাদিক চাইলেই সব প্রতিকূলতাকে জয় কোরতে পারে আপনি তার উধাহরন।

  12. নমস্কার দাদা,
    অসংখ্য ধন্যবাদ এত সুন্দর একটি লেখা পরিবেশনের জন্য।আমি বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রামে থাকি,অথচ এই লেখায় আপনার সাথেই যেন বিশ্ব ভ্রমনের স্বাদ চেটেপুটে আস্বাদন করলাম।আপনার এই আন্তরিক সাংবাদিকতার একজন গুনমুগ্ধ আমি।এই ভাবেই আরও একশ বছর আনন্দ দিন আমাদের।সুস্থ থাকবেন আর অনেক ভালো থাকবেন এই কামনা করি।

    আপনার 25 বছরে আমার আন্তরিক নিমন্ত্রন আর শুধুই মুগ্ধতা রেখে গেলাম।

    সুমন মন্ডল
    ময়ুরেশ্বর,বীরভূম।

  13. Best wishes to you in your new position. I commend you for your achievement and hope you will enjoy its rewards for years to come. We compliment you on your success and send our best wishes for the future. We appreciate your devotion to your position and wish that we had more leaders like you.

  14. Hi Anilava…. Awesome stories .. they are worth celebrating your silver jubilee in journalism… Nice compilation …keep it up.

  15. There are many journalists who break stories and cover new grounds. Anilava Da restores faith in mankind and as he uncovers the unknown. I have had the privilege of spending some quality time with him on cricket tours. The world has seen the journalist in the man but I have seen the man in that journalist. That man is beautiful, he is kind, unassuming, he is extremely hardworking, focussed and presents that human touch to his craft. Before meeting him I only knew angles of batting but after meeting him I was introduced to angles in storytelling. He is also a people’s man. I am proud to share how he inspired his team-mates, most notably Debashish (Mama), to realise their potential. Today Debashish travels the world all alone tailing the Indian cricket team. He knows his game largely thanks to Anilava Da. It is not surprising that even Debashish doesn’t look for short cuts. I am also proud to share the instance of how Anilava Da went all out to help Debashish’s ailing mother. She is no longer with us but I am certain she is still showering her blessings on Anilava Da for his untiring efforts to save her.

    Dada, I will request you to return to active journalism and gun for more stories. We need your skill. For the time being a big thanks for the memories. Thanks for inspiring.

  16. ২৫ এ হবেনা।। কাশী দা ঠিক বলেছে‌। ৫০টা অন্তত চাই।। এ তো শুধু স্টার্টার হল।।

  17. আমি মুগ্ধ। মনে হচ্ছে আমি নিজেই স্বপ্নের জগতে রয়েছি।

Comments are closed.