ভারতীয় ফুটবলের এই অবস্থার জন্য কি কোচ একা দায়ী?

Photos : AIFF

আকাশ দেবনাথঃ প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা।” এই গানের কথাগুলোই এখন কার্যত ঘুরপাক খাচ্ছে ভারতীয় ফুটবল মহলে। যুদ্ধ কবলিত আফগানদের দ্বিতীয় দলের সামনে নাকানিচোবানি খাওয়ার পর আরও বেশি করে সামনে চলে এসেছে জাতীয় দলের দৈনদশা। কিন্তু প্রশ্ন হল, প্রশ্ন করবে কে? দেড়শো কোটির দেশে ১৫ টা ফুটবলার নেই যাঁরা অন্তত ৯০ মিনিট লড়াই টুকু দিতে পারেন? ফুটবল মহলে কান পাতলেই বোঝা যায়, ভারতীয় ফুটবলে অনেক কিছু থেকেও নেই। আবার অনেকে সবকিছু জেনেও কিছু জানেন না। কারণ মুখ খুলে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার সাহস কারও নেই।

বল পায়ে ড্রিবল থাকুক না থাকুক, পরস্পরের পিঠ চুলকে আর লবি বানিয়ে ফুটবলতন্ত্রের মাথায় বসে থাকাই এখন ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় স্কিল। আর লবিবাজির ভেল্কিতে গা ভাসাতে না পারলে, আপনি কৃষানু দে হলেও আপনার জায়গা হবে বেঞ্চে কিংবা মাঠের বাইরে।


আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে হারের পর বহু সমর্থকই কোচ ইগর স্টিমাচকে দুষছেন। এশিয়ান কাপে গোল্লা পাওয়ার পর বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বেও এমন পারফরম্যান্স হলে কোচের উপর তার দায় বর্তায় বৈকি। অবশ্য দায় বর্তালেই বা কী? ভারতীয় ফুটবলে কে আর দায়ের হিসেব রাখে? ইগরও ভাল করেই জানেন সে কথা, তাই ন মাসে ছ মাসে আসেন ক্লাবের খেলা দেখতে, আর জাতীয় দলের খেলা থাকলে মাঠের ৯০ মিনিট ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গেই অজুহাতের ফিরিস্তি তৈরি হয়ে যায়। সমর্থকেরা যতই গাল দিন, কোটি টাকা বেতন নিলে হাসি হাসি মুখে ওসব এড়িয়ে যাওয়াই যায়। মাঝে মাঝে আবার আই লীগ কিংবা সুপার কাপ নিয়ে কটাক্ষ করলে তো বাড়তি হাততালি।

আরও পড়ুন- আইপিএলের এই নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুললেন সৌরভ-পন্টিং

কিন্তু জাতীয় দলের এই অবস্থার জন্য কোচ কি একা দায়ী? এক কথায় উত্তর হল, ‘না‘। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খুব একটা আহামরি কিছু না করতে পারলেও জাতীয় দলের হয়ে স্টিভন কনস্ট্যানটাইনের সাফল্য অন্তত বর্তমান কোচ ইগরের থেকে একটু হলেও বেশি। গদি ছাড়ার আগে সেই স্টিভনই ইশারায় বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, জাতীয় দলের ভিতরেই রয়েছে আরও একটা দল। সেদিনের সেই দলবাজির নায়করাই আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছেন যে কোচ নন, ম্যাচের আগে তারাই নাকি ঠিক করে দেন প্রথম একাদশ। আর সেই দলের মাথায় রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় ফুটবল তারকারা। জাতীয় দলে কারা খেলবেন আর কারা খেলবেন না, সবই স্থির হয় তাঁদের অঙ্গুলি হেলনেই।

আরও পড়ুন- কেকেআর ম্যাচে বড় রেকর্ড গড়তে পারেন বিরাট কোহলি

শুধু কি জাতীয় দল? দেশের এক নম্বর লীগ আইএসএলেও একই গুঞ্জন। দেশের সেরা প্রতিভাদের ভবিষ্যতও নাকি এখন ওই লবিই ঠিক করে দেয়। খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই আঁতাতে রয়েছেন কিছু কর্তা, ও এজেন্টও। আইএসএল আসার পর থেকেই শুরু হয়েছে এজেন্টদের বাড়বাড়ন্ত। কোনও তরুণ খেলোয়াড় যতই ভাল খেলুন, যতক্ষণ না এজেন্টের পা ধরছেন তত ক্ষণ ভাল দল পাওয়া কার্যত অসম্ভব। আর যদি এজেন্ট নেওয়ার টাকা না থাকে তাহলে তাঁর ভবিষ্যত খেপের মাঠেই শেষ। এই এজেন্টরাই দল বদলের বাজারে নাম ভাসিয়ে দেন খেলোয়াড়দের। সেই হওয়ায় খেলোয়াড়টির দরবৃদ্ধি হয়। প্রচারগুণে ৫০ লাখের খেলোয়াড়ের দাম ওঠে কয়েক কোটি টাকা। তারপর সেই এজেন্টরাই ফুটবলারদের বলে দেন কোন দলে যোগ দিতে হবে, কোন দল এড়িয়ে চলতে হবে। আর এজেন্টদের কানে দল বাছাইয়ের গুরুমন্ত্র দেন সেই লবির মাথায় বসে থাকা খেলোয়াড়। সেই কারণেই দশে মিলে নির্দিষ্ট কিছু দলে যোগদান।

আরও পড়ুন- কোন অঙ্কে আইএসএল লিগ শিল্ড জিতবে মোহনবাগান? জেনে নিন সমীকরণ

দেশের পয়লা নম্বর লীগে হাতে গোনা কয়েকটি দল রয়েছে যেখান থেকে সিংহভাগ খেলোয়াড় জাতীয় দলে ডাক পান। তরুণ খেলোয়াড়রাও ভাল করেই জানেন সে কথা। অন্য দলের ভাল প্রস্তাব থাকলেও তাই তাঁদের সেই হাতে গোনা দলগুলিতেই যেতে হয়। এমনকি গোটা মরশুমে কার্যত বেঞ্চে বসে কাটাতে হলেও। চলতি বছরের শীতকালীন উইন্ডোতে যে দলবদল হয়েছে তাতে জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের যাতায়াত দেখলেই বিষয়টা জলের মতো সাফ হয়ে যায়। তাই গোটা মরশুমে নাম মাত্র পায়ে বল লাগানো খেলোয়াড়রা জাতীয় দলে জায়গা পেয়ে যান। অথচ মহামেডানের ডেভিড, আইজলের লালবিয়াকনিয়া, লালহলুদের নন্দ কিংবা ওড়িশার ইসাকের জায়গা হয় না। জাতীয় দলের কিছু তরুণ খেলোয়াড় ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, কখনও কখনও নাকি ম্যাচ শুরুর আগে আচমকাই বদলে যায় প্রথম একাদশ। তবু কোনও খেলোয়াড় সেসব নিয়ে মুখ খোলার সাহস পান না। গদি বাঁচাতে ইগরও তাল মিলিয়ে চলেন।

নামতে নামতে ফিফা ক্রমতালিকায় ভারতের স্থান এখন ১২২। পতন যে ভাবে চলছে তাতে আরও তলানিতে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসলে এখন ভারতীয়রা নীতি বোধের চর্চার থেকেও নায়কপূজায় বেশি স্বচ্ছন্দ। তাই কে বা কারা এই সব করছেন, তাঁদের নাম জানার পরেও তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার কেউ নেই। বরং তাদের তালে তাল দেওয়াই বিধেয়। তাই অদূর ভবিষ্যতে অন্তত এই আঁতাত ভাঙার খুব একটা আশা নেই। সম্প্রতি ফেডারেশনের বাজেটেও সেই ইঙ্গিত মিলেছে। এমনিতেই ফেডারেশনের ঘটি বাটি সবই এফএসডিএলের কব্জায়। তার মধ্যে তৃণমূল স্তর থেকে খেলোয়াড় তুলে আনার খরচ কমিয়ে, টাকা ঢালা হয়েছে পিআর অর্থাৎ আত্মপ্রচারের খাতে। অতএব, যতদিন ভারতীয় ফুটবলের লাগাম ধরা দেবীর মুখে হাসি আছে, ততদিন ঢক্কানিনাদ বজায় থাকবে।