১০ এপ্রিল। ভারতীয় ফুটবলের তর্পণের দিন। আপনার শ্রদ্ধাঞ্জলি পাবে তো রহিম, পিকে, চুনীরা?

অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়: সেটা ১৯৯৪-৯৫ সাল। আজকাল পত্রিকায় ফ্রিল্যান্স করি। ক্রীড়া দপ্তর তখন চাঁদের হাট। কে নেই সেখানে! আমাদের মতো ফ্রিল্যান্সদের কাগজে জায়গা পাওয়া কঠিনই ছিল। নাম করা সব সাংবাদিক এবং তাঁদের জন্যই ধার্য এক একটা অ্যাসাইমেন্ট। কেউ ইস্টবেঙ্গল, কেউ মোহনবাগান, কেউ মহামেডান। কেউ খোঁজ রাখছেন আইএফএ-র,কেউ সিএবি-র। জানি না, দৈনিক সংবাদপত্রের অফিসগুলোয় এখন আর এভাবে অ্যাসাইমেন্ট ভাগ হয় কিনা। এখন তো সব খবরই চলে আসে মোবাইল ফোনে। সোশ্যাল মিডিয়ায়। তখন ক্রীড়া সাংবাদিকতায় সাফল্যের একটাই ইনডেক্স।

খেলোয়াড়, অফিসিয়াল, এমনকী ক্লাবের মালিটার সঙ্গেও তোমার কেমন সমীকরণ! আমার নামের পাশে বেশিরভাগদিনই স্পোর্টস এডিটর লিখে রাখতেন স্পেশাল স্টোরি। অর্থাৎ মাঠে-ময়দানে যেখানে-সেখানে ঘুরে তুলে আনো খবর। ভাল হলে ছাপা হবে, টাকা পাবে। না হলে নয়। আমার স্পেশাল স্টোরি খোঁজার স্বর্গরাজ্য তখন ছিল স্পোর্টস অথারিটি অফ ইন্ডিয়ার পূর্বাঞ্চল কেন্দ্রে। দিনরাত পড়ে থাকতাম ওখানে। সিকিউরিটি থেকে ক্যান্টিনের ছেলে, সবাই আমাকে চিনত। সাইয়ে তখন উঠতি খেলোয়াড়রা ট্রেনিং নিত কিংবা বিভিন্ন ন্যাশানাল টিমের ক্যাম্প চলত। তাই খবরও থাকত অনেক। আর খবরের খোঁজে আমিও প্রায় নিত্যদিনই ধাওয়া করতাম ওখানে। সেখানেই আলাপ এস এস হাকিমের সঙ্গে। আলাপ এবং ঘনিষ্ঠতাও। সাই পূর্বাঞ্চল কেন্দ্রে আঞ্চলিক অধিকর্তা হয়ে এসেছিলেন তিনি সেসময়। খুব স্নেহ করতেন আমায়। মহামেডানে তখন কোচ নিয়ে খুব ডামাডোল। রোজই প্রায় কোচ বদল হচ্ছে। ওরা হাকিমসাহেবকে কোচ করেছিল।

হাকিমসাহেব এক্সক্লুসিভ খবর দিয়েছিলেন আমায়। গোটা দুনিয়া তখন মহামেডানের কোচের নাম খুঁজে বেড়াচ্ছে। ‘আজকাল’-এ স্পোর্টস পেজে লিড ছিল, নতুন কোচ হাকিম। একটু হইচই হয়েছিল। কারণ, হাকিম তো শুধুই কোচ নন। একটা ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। তাঁর মুখেই সেসময় সৈয়দ আব্দুল রহিমকে নতুন করে চেনা। তার আগে সবটাই চুনীদার লেখা ‘খেলতে খেলতে’ কিংবা প্রদীপদার লেখা ‘উইং থেকে গোল’-এ পড়া। আনন্দমেলায় বের হত সেগুলো। বাবা এক বছরের ‘আনন্দমেলা’ বাঁধিয়ে রাখত বাড়িতে। কত স্মৃতি।

হাকিম সাহেবের সঙ্গেও অনেক স্মৃতি জড়িয়েছিল। প্রায় নিয়মিতই সাইয়ে তাঁর বাংলোয় আড্ডা মারতে যেতাম। একদিন হঠাৎ ছোট একটা চটি বই হাতে ধরিয়ে বললেন, ‘এটা বাবার লেখা বই। তোমাকে দিলাম।’ রহিম সাহেব ফুটবল নিয়ে বই লিখে গেছেন, জানা ছিল না। দেখি মলাটে লেখা, ‘হাউ টু প্লে ফুটবল’। ইংরাজিতে লেখা, বড়জোর ২৫-৩০ পাতার বই। হলুদ হয়ে গেছে সব পাতা। কত বড় অমূল্য সম্পদ, তখনই জানতাম। দক্ষিণেশ্বরে আমাদের বাড়িতে এখনও রাখা আছে সেই বই। তবে এই বইটা বোধহয় আগামীদিনে বনি কাপুরের সংগ্রহে রাখা উচিত। বনিজীকে সেদিন এক্সেল এন্টারটেইনমেন্টের অফিস থেকে বেরিয়ে জানিয়েওছি সেটা। ‘এটার দাবিদার এখন শুধুই আপনি। রহিম সাহেবকে, ভারতের ফুটবলের সেই সোনার সময়কে যেভাবে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানালেন আপনি, মনে রাখবে এদেশের প্রতিটা ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ।’

গত সপ্তাহেই একদিন মাঝরাতে বনিজী-র ফোন। ‘তোমাকে পরশু দুপুরের টিকিট পাঠাচ্ছি। ‘ময়দান’-এর প্রাইভেট শো রাখছি একটা। আমি চাই, তুমি দেখ ছবিটা।’ মুম্বইয়ে এক্সেল এন্টারটেইনমেন্টের অফিসে প্রাইভেট একটা থিয়েটার হলে ছবিটা দেখানো হল। রাকেশ রোশনের মতো বেশ কিছু বলিউড প্রযোজকও দেখলাম এসেছেন ছবিটা দেখতে। বলিউড ইন্ডাস্ট্রির আরও অনেক লোকজনও নিশ্চয়ই ছিলেন। এবং তাঁরাও হাততালিতে ভরিয়ে দিলেন ময়দানকে। ম্যাচের প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা আবেগের ওঠানামাতেও বলিউডের এলিট ক্রাউডও ভেসে গেল আবেগে, হর্ষধ্বনিতে। বনি কাপুরের স্বপ্নের প্রজেক্ট ছিল এটা। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে জানতাম, রহিম সাহেবের বায়োপিক নির্মাণের ব্যাপারে কোনওরকম আপোষ করেননি তিনি। মুম্বইয়ের কাছেই তৈরি করেছিলেন একটা স্টেডিয়ামের সেট। যেটা আসলে হয়ে উঠেছিল জাকার্তার গেলারো বুং কর্ণ স্টেডিয়াম। দু’বার এই সেট ভাঙতে হয় প্রোডাকশন টিমকে। একবার কোভিডের জন্য। আরেকবার মুম্বই সাইক্লোনের জন্য। অন্তত পাঁচবার নানা কারণের জন্য সিনেমার মুক্তি পিছিয়েছে। তারপরও হাল ছাড়েননি ওঁরা। কোনও কিছুতে এতটুকু ফাঁক রাখতে চাননি। পরিচালক অমিত শর্মার অনুরাগী আগেও ছিলাম। ‘বাধাই হো’ দেখে নয়। ইউটিউবে গুগলের একটা অ্যাড পাবেন, ভারত-পাকিস্তান নিয়ে। পারলে সেই বিজ্ঞাপনটা দেখে নেবেন। প্রথমবার সেই ফিল্ম দেখেই অমিত শর্মার অনুরাগী আমি। তবে এটা স্পোর্টস ফিল্ম, ইতিহাসের গল্প। পরিচালক কীভাবে সেই গল্পটা বলেন, জানার আগ্রহ ছিল। তারপর এমন একটা খেলা, যেটা এদেশের অর্ধেক মানুষ জানে না। ভারতের ফুটবল নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। তারা বিদেশি ফুটবল জানে, কিন্তু জানে না যে আমাদের ফুটবলেরও একটা সোনার ইতিহাস ছিল!

আরও পড়ুন: কলকাতা ডার্বি নিয়ে স্মৃতিচারণা স্বয়ং ফিফা প্রেসিডেন্টের

হেলসিঙ্কি ১৯৫২। শৈলেন মান্নার দল যুগোশ্লাভিয়ার কাছে হারল ১০-১ গোলে। ১৯৪৮-এ লন্ডন অলিম্পিকে খালি পায়ে খেলে প্রশংসা জুটেছিল অনেক। ‘৫২তে এল শুধুই তিরস্কার আর সমালোচনা। প্রধান কোচ রহিম ভারতীয় ফুটবল কর্তাদের বুঝিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভাল খেলতে হলে বুট পরে খেলতে হবে। আর খেলা ৭০ মিনিটের নয়, ৯০ মিনিটের হওয়া দরকার। ঠিক দশ বছর পর এশিয়ান গেমসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল রহিমের ছেলেরা। এই জার্নিটার গল্প ধরা আছে ময়দানে। ধরা আছে একটা ভুলে যাওয়া সময়কে, একটা সাফল্যের সৌধকে। যে সৌধটাকে ভাল করে সাজালে সারাজীবন লাইট হাউস হতে পারত ভারতীয় ফুটবলের, সেই সৌধটাকেই গুঁড়িয়ে ফেলেছি আমরা। বলিউড সেই শ্রদ্ধাঞ্জলিটাই দিল রহিম সাহেবকে। পিকে ব্যানার্জি, চুনী গোস্বামী, তুলসীদাস বলরাম, থঙ্গরাজ, জার্নেল সিং, ফ্র্যাঙ্কো, প্রদ্যোত বর্মণ, রামবাহাদুর- সবাইকে। আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল কোরিওগ্রাফি। মনে হবে যেন কোন স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখছেন। বিদেশ থেকে ফুটবল কোরিওগ্রাফি টিম এনেছিলেন বনি কাপুররা।

অসাধারণ কাজ করে গেছেন তাঁরা। দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচে জার্নেল সিংয়ের সেই গোল- গায়ে কাঁটা দেবেই। হ্যাঁ, আক্ষরিক অর্থেই কাঁটা দিচ্ছিল। কখনও চোখে জলও আনছিল। একটা কোচের স্বপ্নের জন্য লড়াই। লড়াই, আত্মত্যাগ তাঁর পরিবারের। শরীরে মারণরোগ, ফুসফুসে ক্যান্সার। তবু স্বপ্ন জেগে থাকে। আর সেই স্বপ্নের খোঁজেই সেকেন্দ্রাবাদের হাবসিগুডা গ্রাম থেকে তুলসীদাস বলরাম, গোয়া থেকে ফ্র্যাঙ্কো, বাংলা থেকে চুনী গোস্বামী, রেল থেকে পিকে ব্যানার্জি, অরুন ঘোষদের খুঁজে বার করেন তিনি। অসাধারণ এই ছবির কাস্টিং। চুনী গোস্বামীর ভূমিকায় অমর্ত্য রায়। অমর্ত্য অভিনেত্রী চৈতি ঘোষালের ছেলে। এর আগে সুদীপ্তা চক্রবর্তীর সঙ্গে বাংলা সিনেমা ‘উড়নচন্ডী’তে অভিনয় করেছে। মিতালি ঘোষালের হিন্দি ছবি ‘টোয়েন্টি টু ইয়ার্ডস’-এও ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। এই ছবিতে অমর্ত্য অসাধারণ। চোখে পড়ার সোল টার্ন করছিল। যেন পেশাদার কোনও ফুটবলার অভিনয় করছে ফিল্মে। আর চেহারাতেও কোথায় যেন মিল- আপনাকে ভাবতে হবেই। অরুন ঘোষের ভূমিকায় আমন মুন্সি ফুটবলার সন্দীপ মুন্সির ভাইপো আর অভিনেতা টাবুন মুন্সির ছেলে। সম্প্রতি আমার পরিচলনাতেই শর্ট ফিল্ম ‘মেসি’তে অসাধারণ অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছে আমন। তবে অভিনেতা নয়, আমন ফুটবলার হতে চায়। সেও অসাধারণ এই ছবিতে। বাংলার আরেক ছেলে তন্ময় ভট্টাচার্য আছেন প্রদ্যোত বর্মণের ভূমিকায়। বাকিরাও অসাধারণ। পিকে ব্যানার্জি, জার্নেল সিং, বলরাম, থঙ্গরাজ- কাকে ছেড়ে কার কথা বলবেন। মাসের পর মাস এরা একসঙ্গে থেকেছেন। প্র্যাকটিশ করেছেন। কোভিড গেছে, আরও নানা প্রতিকূলতা এসেছে। শেষমেশ তৈরি হয়েছে একটা ‘ময়দান’। রহিম সাহেবের ভূমিকায় অজয় দেবগনের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই, তাকে নতুন করে আবিষ্কার করবেন দর্শকরা। তবে চমকে দিয়েছেন আমাদের রুদ্রনীল ঘোষ। গজরাজ রাওয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করলেন রুদ্র। কী অসম্ভব প্রতিভা। কেন যে রাজনীতির বেনোজলে নষ্ট করছেন সবটা, যুক্তি দিয়ে বিচার হয় না।

আর একেবারে শেষ দৃশ্যে এসেছিলেন ওঁরা। আসল সোনার ছেলেরা। পিকে, চুনী হুইল চেয়ারে। যুবভারতীর সবুজে তাঁদের চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে বলরাম, ফ্র্যাঙ্কো, অরুন ঘোষরা। অরুন ঘোষ ছাড়া কেউ এই পৃথিবীতে নেই। অরুন ঘোষও এখন কিছু বুঝতে পারেন না। স্মৃতিশক্তি নেই প্রায়। তাই ওঁরা কেউই দেখতে পারলেন না যে শেষ অবধি ভারতীয় সিনেমা তাঁদেরও সেলিব্রেট করল। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গেল!

শেষ দৃশ্যে হাসছিলেন ওঁরা সবাই। অসুস্থ প্রদীপদা, চুনীদার মুখেও সেই চেনা হাসি। বেঁচে থাকলে এই ছবি দেখলে কী বলতেন, ভাবার চেষ্টা করছিলাম!
না, ভাবব না। স্মৃতি বড়ই বেদনার। আবার চোখ ভিজিয়ে দেবে। বরং কাউন্টডাইন শুরু করি। ১০ এপ্রিল। ফুটবল ভালবাসলে আমাদের সোনার ছেলেদের আর এক স্বপ্নালু মাষ্টারমশাইয়ের তর্পণ সারতে সিনেমা হলে যাবেন প্লিজ। সিনেমা হলেই। টিভিতে দেখলে স্টেডিয়ামে খেলা দেখার মজাটাই পাবেন না।