অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় : '৮৬-র বিশ্বকাপের আগেই কি টিভিটা এলো আমাদের? একটু ডাউন মেমোরি লেনে হেঁটে মনে পড়ল, না বিশ্বকাপ নয়। বরং সেদিনটা ছিল সুপার সকারের একটা ম্যাচ। ভারতের ফুটবল দল খেলছে সম্ভবত বোখুমের সঙ্গে। জামশেদপুরে। ব্রাজিলের দলের বিরুদ্ধে দুটো গোল করলেন আমাদের বিজয়কুমার। পরে বিজয়দাকে অনেকবার দেখেছি। টি এফ এর কোচ হয়েছেন। দেখা হলেই হাসতেন। হাসতে হাসতে একদিন শুনলাম চলেও গেলেন। বিজয়কুমারকে ভারতের ফুটবল মনে রাখেনি। রাখার কথাও নয়। কত ফুটবলারই তো এইভাবে, "চুপিচুপি, একা একা...।" কিন্তু আমি ভুলতে পারলাম কই! ওই যে দুটো গোল নতুন টিভির পর্দায় বিদ্যুতের ঝলকানি দিয়ে গেল, সেই ছবি যে আমার স্মৃতির হার্ডডিস্কে চিরস্থায়ী জায়গা নিয়ে নিল। ছোটবেলাটা আসলে এরকমই। সেই নতুন ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা খড়ির দাগ। উঠতেই চায়না। চেনা বিজ্ঞাপনটার কথা মনে পড়ছে। ‘দাগ আচ্ছা হ্যায়’। ছোটবেলার সেই সব দাগ আসলে আচ্ছাই হ্যায়। পরীক্ষার খাতায় লাল কালির দাগ, স্কুলের জামার পিছনে বন্ধুদের ছেটানো নীল কালির দাগ, সব দাগগুলোকে এখন বড্ড দামী মনে হয়। পিছন ফিরে এখন দেখি, শৈশব-কৈশোর জুড়ে যে লাল, নীল, হলুদ, সবুজ কতরকম দাগ! সবটা রঙিন, সবটা নির্ভেজাল, সবটা খাঁটি। আর এই দাগগুলোর সঙ্গেই একটা দাগ চিরস্থায়ী হয়ে গেল হৃদয়ে।
আকাশি আর সাদা। স্ট্রাইপ। দিয়েগো মারাদোনার শরীরের দাগ,জার্সির রঙ- আমার সারা শরীর, মনে দাগ কেটে গেল আজীবনের মত। মা'এর পুরোনো শাড়ি কেটে ছোট্ট টেবিলটা ঢাকা দেওয়া হল। তার ওপর বসল টিভি। বাংলাদেশের টিভিতে দেখা যাবে বিশ্বকাপ। বুস্টার এলো। অ্যান্টেনার মাথায় আরও একটা অ্যান্টেনা। খেলা শুরু হবার আগে কাউকে অবধারিত ভাবে ছাদে উঠতে হত। অ্যান্টেনার মুখ এদিক ওদিক করে বাংলাদেশের ছবিকে জীবন্ত করার বিফল চেষ্টা চলত। ছবি সেই জলছবির মত। তারপর একদিন খবর এল, দূরদর্শন দেখাবে খেলা। মেক্সিকো চলে এল বাংলার ঘরে ঘরে। পাড়ায় পাড়ায় হাতে গোনা বাড়িগুলোর টিভির সামনে ভিড়। রাতজাগা। দিনে ঘুমানো। আর রাতজাগা চোখেই একদিন দেখা পাওয়া তাঁর। বাঁ পায়ের ছোঁয়ায় অনায়াসে কেটে যাচ্ছে সবটা। মাঠের মধ্যে যেন তুলি দিয়ে আলপনা দিচ্ছেন। মারাদোনার সঙ্গে সেই প্রথম আলাপ। তারপর জীবনের সবকটা বাঁকে অদ্ভূতভাবে তিনি আছেন। সাফল্য, ব্যর্থতা, আনন্দ, হতাশা, প্রেম, অপ্রেম, প্রতিবাদ -সবটা জুড়ে তিনি। আমার ধারণা, আশির দশকে স্কুল, কলেজ জীবন পার হওয়া খুব কম মানুষই বোধহয় এই দিয়াগো ভাইরাসের সংক্রমনের বাইরে ছিলেন। হ্যাঁ, আক্রান্তই ছিলাম আমরা। এ এক অদ্ভূত আবেগ।
কে জানে, কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরের একটা মানুষকে দেখলে কী করে এত অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ হত। হ্যাঁ, আবেগের স্ফুলিঙ্গ। আবেগের বিস্ফোরণ। মাঝমাঠ থেকে বলটা ধরছেন, একটু ঝুঁকে, দু পায়ের মাঝখানে বল, আচমকা যেন অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিচ্ছেন। ছিটকে যাচ্ছে দু'ধারের সব বাধা। গোল করছেন অথবা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। নিখুঁত ঠিকানা লেখা একটা পাস। আর ফিরেও আসছেন সেইভাবে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, হাওয়ায় ছুঁড়ে দিচ্ছে তার অটোগ্রাফ।
২০০৮'এ কলকাতায় এসে মহেশতলার অনুষ্ঠানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে যখন কলকাতার আকাশে ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন ওইরকম মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, জিভের কাছে কিছু নোনতা কিছু ঠেকছিল। কে জানে, কখন নেমে এসেছে চোখের জল। জানিনা, মারাদোনা কেন কাঁদাতেনও! আমার মা ফুটবলের কিছু বুঝত না। কিন্তু মারাদোনাকে দেখার জন্য টিভির সামনে বসত। ’৯০ এ মারাদোনার যখন চোখে জল, মাকেও কাঁদতে দেখেছি। কে জানে কেন! আসলে টিভির পর্দায় দেখা এই মানুষটা দিনের পর দিন এক পৃথিবী মানুষের প্রতিদিনের হারতে হারতে বেঁচে ওঠার রসদ ছিলেন। মাটিতে পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়ানো যায়, সব নিয়ন্ত্রন হারিয়েও জিতে যাওয়ার গোলটা করে আসা যায়, এক পৃথিবী মানুষকে শিখিয়েছিলেন তিনিই। মারাদোনা তাই এই পৃথিবীর মাঝেই একটা আর্দ্ধেক গোলার্ধ, একটা অন্য বিশ্ব, নিজস্ব ধর্ম। আমরা সবাই সেই ধর্মেই দীক্ষিত।
২০১৪ বিশ্বকাপ। রিওর কোপা কাবানা বিচের মিডিয়া সেন্টারে বসে কপি পাঠাচ্ছি। হঠাত দেখি, একটা স্থানীয় সাইটে মারাদোনার ছবি। কোন একটা হোটেলের সামনে বিশ্বকাপের কয়েকজন ফুটবলার তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলেছেন। যে টিমের ফুটবলারদের ছবিতে দেখলাম, পরের দিনই তাঁদের ম্যাচ রিওতেই। বুঝলাম, মারাদোনা পৌঁছে গেছেন রিওতে। খোঁজ শুরু হল। হোটেলটা জানার চেষ্টা করছিলাম। কোন হোটেল হতে পারে। অনেককে জিজ্ঞেস করার পর এক স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক বললেন, এটা অ্যারিস্টক্র্যাট হোটেল। অ্যাটল্যান্টিকের ধারেই। এক মূহুর্ত আর দেরি করিনি, রওনা হয়ে গেছিলাম ওই হোটেলের দিকে। হোটেলের সামনে দেখি এক আর্জেন্টিনার টিভি চ্যানেলের মহিলা সাংবাদিক দাঁড়িয়ে। তিনিই কনফার্ম করে দিলেন, হ্যাঁ এই হোটেলেই আছেন দিয়াগো আর্মান্দো মারাদোনা। তারপর ওই হোটেলের বাইরে অনন্ত প্রতীক্ষা। মারাদোনা এলেন। ঢুকে গেলেন রেস্তোরাঁয়। কোলে একটা ছোট্ট ছেলে। আর্জেন্টিনার সাংবাদিকটি বললেন, এ হচ্ছে নতুন শিশুপুত্র। ব্রাজিলে এসেছে বান্ধবী ভেরোনিকা আর তাঁর এই সন্তান নিয়ে। আর এইসব নিয়ে ক্লদিয়া আর দুই মেয়ের সঙ্গে ঝামেলা লেগে আছে। হাসলাম, এ আর নতুন কী! সেই ছোট থেকেই তো এসব শুনে আসছি, তবু কাঁচের ওপারে যে মানুষটাকে সরাসরি দেখতে পাচ্ছি তখন, তাঁর সম্পর্কে রোমান্টিকতা এক বিন্দু ছাড়তে পারিনি। সেদিন আর কিছু হল না। হোটেলেই ঢোকা গেল না। বাইরে থেকেই কিছু ছবি পেলাম। পরে আবার সেই হোটেলে চলে গেলাম।
আমার বিশ্বকাপ তখন শুধুই মারাদোনা। পরেরদিনই বোধহয় বিশ্বকাপের ফাইনাল। অ্যারিস্টোক্র্যাট হোটেলের সিকিউরিটি ম্যানেজ করে লবিতে গিয়ে বসলাম। দেখি দুঙ্গা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কিছুক্ষন পর নামলেন মারাদোনা। কোলে সেই ছেলে। দলবল নিয়ে কোথাও একটা বের হচ্ছেন। ক্যামেরা বন্দী রাখছে সবটা। সেই ক্যামেরাম্যানের কাছেই জানতে পারলাম, মারাদোনা যাচ্ছেন ইন্টারন্যাশানাল ব্রডকাস্টিং সেন্টারে। সেখানে ভেনেজুয়েলার একটা চ্যানেলের হয়ে তিনি বিশেষজ্ঞর ভূমিকায় কাজ করছেন। ততক্ষনে দুঙ্গার সঙ্গে মারাদোনার দেখা হয়ে গেছে আর দুজনে চুটিয়ে আড্ডা মারছেন। ছবি তুলে যাচ্ছি আমিও। সেখান থেকে দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ঠিক করলাম, আমিও যাব আই বি সি তে। ফিফার ব্রডকাস্টিং ইউনিটটা ছিল শহরের বাইরে। বাসে করে আমি যখন পৌছালাম তখন প্রায় মাঝরাত। সঙ্গী হাওড়ার ছেলে অরুনাভ কর। মারাদোনার তখনও স্টুডিওর কাজ শেষ হয়নি। বেশ কিছুটা পর বের হলেন। সেদিন সম্ভবত শেষ শো ছিল। গোটা শ্যুটিং ইউনিট তাঁকে বিদায় জানাতে বাইরে চলে এসেছে। গলায় একটা তোয়ালে জড়িয়ে তিনিও তাঁদের জড়িয়ে ধরছেন। ছবি তুলছেন। হাবভাব একদম, চেনা বাবলুদা কিংবা মিঠুন চক্রবর্তীর মত। একটা মেঠো সোয়্যাগ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। সেভাবেই বের হলেন। বেশ খানিকটা হেঁটে বাইরের প্রধান দরজা। সুযোগ পেতেই পাশে চলে এলাম। কলকাতা থেকে সেই ছবিটার একটা প্রিন্ট করিয়ে নিয়ে গেছিলাম। যুবভারতীতে গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে মারাদোনা। সেই ছবিটা দেখালাম। হাতে নিয়ে কিছু একটা বললেন। আমি কিছু না বুঝতে পেরেই বললাম, কলকাতা, ইন্ডিয়া। তিনিও দুবার উচ্চারণ করলেন, ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া। তারপর ওই ছবিতে সই করে দিলেন। তখন প্রায় ভোররাত ব্রাজিলে। মারাদোনা যখন বের হচ্ছেন, তখনও সেখানে বেশ কিছু মারাদোনা সমর্থক। মারাদোনার জন্য গান গাইছেন। ওই সেই গানটা, যেটা দিয়ে গোটা বিশ্বকাপ মাতিয়ে রাখেন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। ব্রাজিলের সমর্থকদের সঙ্গে ওদের মাঠের বাইরে যত লড়াই সেই গানে। ওরা বলেন, পেলে সেরা, এরা বলেন মারাদোনা। সেদিন কাসা রোসাডার বাইরে জড়ো হওয়া লাখ লাখ মারাদোনা ভক্তদের গলায় আবার সেই গানটা শুনলাম। হাত পা ছুঁড়ে একই ভঙ্গি গান গাওয়ার, শুধু গানে মিশে গেছে কান্না। আগামীদিনে যারা বিশ্বকাপ দেখতে যাবেন, গানটা নিশ্চয়ই শুনবেন, শুনতে পাবেন এই কান্নাটাও। আর্জেন্টিনা থেকে আমার বন্ধু সেবাস্টিয়ান সেদিনই মেসেজ পাঠালো, আমাদের ঈশ্বর ঈশ্বরের কাছে চলে গেলেন। সঙ্গে কয়েকটা ছবি, মারাদোনাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর। ঈশ্বর মানে শাশ্বত। ইটারনাল, ইটারনো। একটা মানুষ, যিনি শাশ্বত, যিনি চিরদিনের। ঈশ্বরের মৃত্যু হয় নাকি। এর পরও মন খারাপের দিনে ইউটিঊব খুলে মারাদোনাকেই খুঁজব....
বেস্ট টেন গোলস অফ মারাদোনা, আগামীদিনেও যে আমাদের মত কত মানুষকে শান্তি দেবে, তা কে অস্বীকার করতে পারবেন! মারাদোনারা আসলে মরেন না। ওভাবেই থেকে যান আমাদের খোঁজে। কখনও গুগলের সার্চ ইঞ্জিনে, কখনও মনের ভিতর প্রবল বিক্ষোভে। আসলে মরে গেছিলাম বরং আমরাই। আমাদের শৈশব, কৈশোর, বেড়ে ওঠা সেসব বাদই দিন। কিন্তু ওই প্রতিবাদী মনটা? যেটা কখনও বিদ্রোহী হতে চাইত, কখনও কখনও নিজেকে বোঝাত, কী যায় এলো গোটা দুনিয়া। যদি তোমার বিষয়ে জাজমেন্টাল হয়ে যায়, তুমি বাঁচো তোমার নিজের শর্তে। নিজের ইচ্ছেয়, নিজের মর্জিতে। এই যে গোটা দুনিয়া জুড়ে হাহাকার দেখছেন, মারাদোনা এদের সবাইকে নিজের শর্তে বাঁচতেও শিখিয়েছেন। প্রতিষ্ঠান বিরোধী হতে শিখিয়েছিলেন। বেপরোয়া হতে শিখিয়েছিলেন। বিদ্রোহী হতে শিখিয়েছিলেন ।
বরং আমরাই চারপাশের সব বদলগুলোর সঙ্গে আপোষ করেই নিয়েছিলাম। কত অন্যায় দেখেও ফেসবুকের পাতাতেও দু লাইন লিখতেও ভয় পাই। আমাদের বিপ্লবী হওয়ার দৌড় যদিও ওই অবধিই। তবুও ভাবি, যদি ধেয়ে আসে আক্রমণ, ভার্চুয়ালিই হোক না, আমি তো মারাদোনা নই, ডোন্ট কেয়ার হয়ে বিপক্ষের গোলপোস্ট অবধি সোজা বল টেনে নিয়ে চলে যাব। তাই যতটুকু পড়ে থাকা রাগ, আমাদের অন্তরমহলের গুমরে থাকে। আপোষ বাড়ে, হতাশা বাড়ে। আজ মনে হচ্ছে, মারাদোনার লেগাসি কি ইউটিউবে থাকা খেলার ভিডিওগুলোই? নাকি অন্য কিছু? মনের ভিতর ওই হতাশাটা, সেটাও কি মারাদোনা? পুষে রাখা রাগ,চাপা রাখা প্রতিবাদ কিংবা এই সবের কোন কিছু না করতে পারার জন্য যে আপশোষ, সেটাও?
দিল্লির বুকে মিছিল করা ওই কৃষকরা কি এক একটা মারাদোনা নন? মারাদোনা দুনিয়াব্যপী মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদ মানেননি, রুখে দাড়িয়েছিলেন বারবার, এরাও তো সেই প্রাতিষ্ঠানিক শোষণের
বিরুদ্ধেই রাস্তায়। যতবার দুনিয়ার কোন কোনায় বিপ্লবের কথা শোনা যাবে, চে-মারাদোনা-কাস্ত্রোরা বেঁচে থাকবেন ওই চেতনাতেই। কেউ ফুটবল খেলে বিপ্লবের কথা বলবেন, কেউ খালি পায়ে লং মার্চ করবেন, কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে শহরের রাস্তায় হাঁটবেন- মারাদোনা বেঁচে থাকবেন এদের সবার মধ্যে। আমার ভীরু মন সাহস পাবে। আবার খুঁজব আমি আমার মারাদোনাকে, আমার অন্তরমহলে!!
ভাল থেকো, আমার মারাদোনা।