সব্যসাচী বাগচী
মাঠের ডানদিক থেকে এক ফুটবলার তীব্ৰ গতিতে এগিয়ে চলেছেন। তাঁর গতি ও পায়ের কাজে বিভ্রান্ত বিপক্ষের ফুটবলাররা। ঠিক কর্নারের কাছে এসেই ডান পায়ের ইন স্টেপে ক্রস তুলে দিলেন সেই ভারতীয় ফুটবলার। বক্সে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর এক সুযোগ সন্ধানী স্ট্রাইকার। হেড কিংবা জোরালো ভলিতে সেই ভাসানো বল বিপক্ষের জালে জড়িয়ে দিলেন তিনি। ‘গোওওলল....’
ফুটবলে এমন দৃশ্য অবিরাম দেখা যায়। যাঁরা ফুটবল ম্যাচের লাইভ টেলিকাস্টের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা অনায়াসে এই সিকুয়েন্সগুলোকে একসঙ্গে জুড়ে আমাদের ড্রয়িংরুমে পৌঁছে দেন। কিন্তু কোনও হিন্দি সিনেমায় ফুটবল ম্যাচকে এভাবে দেখানো হয়েছে? উত্তর, না। 'ময়দান' সিনেমায় ফুটবলের দৃশ্যগুলো দেখলে, আপনাদের মনে হবে যেন লাইভ টেলিকাস্ট দেখছেন!
চুনি গোস্বামীর ড্রিবল। সেখান থেকে ব্যাক কিকে গোল। প্রায় নিজেদের বক্স থেকে বল পায়ে পিকে ব্যানার্জীর সোলো রান। সেখান থেকে গোলার মতো শটে বিপক্ষের জাল ছিঁড়ে দেওয়া। পিটার থঙ্গরাজ ও প্রদ্যোত বর্মনের শরীর ছুঁড়ে দেওয়া একাধিক সেভ। জার্নেল সিংয়ের ফাইনাল ট্যাকেল থেকে বল ক্লিয়ার করা। স্লাইড দিয়ে গোল লাইন সেভ! কিংবা প্রথম ভারতীয় হিসেবে জাপানের বিরুদ্ধে নেভিল ডি’সুজার হ্যাটট্রিক।
ছবিতে দেখানো হয়েছে একাধিক ফুটবল ম্যাচের দৃশ্য। প্রতিটি গোলের সময় প্রেক্ষাগৃহভর্তি দর্শকের ‘গোওওওল’ চিৎকারই প্রমাণ করে দিচ্ছিল, ঠিক কতটা যত্ন করে পরিচালক অমিত রবীন্দ্রনাথ শর্মা বুনেছেন দৃশ্যগুলো। বছরের পর বছর কেটে গেলেও, বাজেট বাড়লেও, দিন-রাত এক করে পরিশ্রম করেছেন প্রযোজক বনি কাপুর। অসংখ্য হারা-জেতা ম্যাচ দেখতে দেখতে টের পাওয়া যাচ্ছিল শিরায় শিরায় অ্যাড্রিনালিনের গতি। ‘ড্রোন শট’ থেকে শুরু করে ‘বডি ক্যাম’ শট, বিদেশি টেকনিশিয়ানদের দিয়ে তৈরি কাজ থেকে আপনি চোখ সরাতেই পারবেন না। ‘ময়দান’ সিনেমার ফুটবলের দৃশ্যগুলো দেখলে মনে হবে, আপনি এয়ার কন্ডিশন রুমে নন, বরং কোনও স্টেডিয়ামের ভিড়ে ঠাসা গ্যালারিতে বসে রয়েছেন!
ভারতীয় ক্রিকেটে যেমন ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয়। ঠিক সেভাবেই ফুটবলের ক্ষেত্রে ১৯৬২ সালের জার্কাতায় আয়োজিত এশিয়ান গেমসে সোনা জয়। পিকে-চুনী-বলরাম-জার্নেল সিংরা। আর তাঁদের কোচ ছিলেন কোচ সৈয়দ আবদুল রহিম। সেই অসামান্য সাফল্যই এবার রুপোলি পর্দায়। ‘ময়দান’-এর আকারে।
তিন ঘণ্টা এক মিনিটের সিনেমা অবশ্য রহিম সাহেবের বায়োপিক বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাস্তব জীবনের রহিম সাহেবের সঙ্গে রিল লাইফের রহিম সাহেব, আকাশ-জমিন তফাৎ। তবে শুধু অভিনয় দক্ষতা ও চোখের এক্সপ্রেশনে সেই অভাব ঢেকে দিয়েছেন অজয় দেবগন। তিনি কত বড় অভিনেতা সেটা লেখার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৯৮ সালে রিলিজ হয়েছিল মহেশ ভাটের ‘জখম’। সেখানেই অজয় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি সর্বোচ্চ পর্যায়ের পারফর্মার।
কয়েকটা দৃশ্যের কথা লিখতেই হবে.....
ফুটবল ফেডারেশন শীর্ষ কর্তাদের দুর্ব্যবহারে চরম অপমানিত রহিম সাহেব। সেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরেই শুরু হয়েছে প্রবল কাশি। এমন একটা কাশির দৃশ্য যে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা যায়, সেটা অজয়ের অভিনয় না দেখলে বিশ্বাস হত না!
পরের সিন। ডাক্তারের কেবিনে রিল লাইফের রহিম সাহেব। জানতে পারলেন তিনি লাঙ ক্যান্সারে আক্রান্ত। হাতে কতদিন সময় রয়েছে, সেটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। ডাক্তারের মুখ থেকে সেই কথা শোনার পরেও, ফের সিগারেট ধরালেন। ডাক্তারবাবু আঁতকে উঠতেই অজয় অর্থাৎ রহিম সাহেব বললেন, ‘সিগারেট ছেড়ে দিলে কি আমি এখন সুস্থ হয়ে যাব? হব না তো? তা হলে আর ছেড়ে কি লাভ?’
অসাধারণ অভিনয়ের দৃশ্য আরও রয়েছে। এশিয়াডের ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে নামার আগে ড্রেসিংরুমে বসে রয়েছে ভারতীয় দল। এদিকে টয়লেটে নাগাড়ে কেশেই চলেছেন তাঁদের কোচ। বেসিন রক্তে ভেসে গিয়েছে। তাঁর শরীরের এমন অবস্থা দেখে হতবাক পিকে-চুনি। শেষ পর্যন্ত দুই তারকার কাঁধে ভর করে সাজঘরে ফিরলেন রহিম সাহেব। ধপধপে সাদা জামার ঠিক বুকের দিকে রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। সেই রক্ত ব্লেজারে ঢেকে দিলেন তিনি। যাতে বাকি ফুটবলারদের ‘মোরাল’ না ভেঙে যায়।
কিংবা বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে মাঠের দিকে হাঁটছেন অজয়। চোখের জল-বৃষ্টির জল মিলে-মিশে একাকার। অথবা ফাইনাল জেতার পর সাইডলাইনের ধারে দাঁড়িয়ে রক্ত ঝরানো সেই কাশি! আপনার চোখে জল আনবেই। শরীরে কর্কটরোগ নিয়েও দেশকে সাফল্য এনে দিতে মরিয়া মানুষটিকে ‘অপার্থিব’ মনে হয়। অজয়ের দুরন্ত অভিনয় রহিম সাহেবকে নতুন প্রজন্মের কাছে ‘জীবন্ত’ করে তুলেছে।
ছবি শুরু ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল দলের যুগশ্লোভিয়ার কাছে ১-১০ হার দিয়ে। জোরালো হতে থাকে কোচকে তাড়ানোর দাবি। তবে হারলেও, রহিম সাহেব কিন্তু আত্মবিশ্বাসী। পালটা কর্তাদের বোঝান, ঘরোয়া ফুটবল ৭০ মিনিটের। যেখানে আন্তর্জাতিক ফুটবল ৯০ মিনিটের। এরসঙ্গে তখনও পর্যন্ত ফুটবলার খেলেন খালি পায়ে। তাছাড়া পুরনো ‘তারকা’দেরই খেলিয়ে যেতে হয়, তরুণদের ব্রাত্য করে। এই সমস্যাগুলো কাটাতে পারলেই সাফল্য সম্ভব। এরপর শুরু হয় রহিমের লড়াই। নিজের মতো ফুটবল দল গড়ে তুলে, ১৯৫৬-তে অস্ট্রেলিয়া অলিম্পিকের পর ১৯৬০-এ রোম অলিম্পিকের চতুর্থ হয় ভারত। কিন্তু কোয়ালিফাইং রাউন্ডে পৌঁছতে না পারায় কোচ রহিম সাহেবকে বহিষ্কার করা হয়।
সিনেমায় রুদ্রনীল ঘোষ ও গজরাজ রাও রয়েছেন খল চরিত্রে। গজরাজ অসাধারণ। তাঁর চোখ-মুখের অভিব্যক্তি দেখলে আপনার রাগ হবেই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যপার হল বাংলা বলার ভঙ্গিমা ও উচ্চারণ। ডায়লগ শুনলে মনেই হবে না গজরাজ হিন্দিভাষী। অন্যদিকে রুদ্রনীলও বলিউড অভিষেকে চমকে দিয়েছেন। ক্রুর হাসি, ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গির মিশেলে তিনিও দুরন্ত। রুদ্রনীলের ‘শুভঙ্কর’কে দেখে মনে পড়ে যায় সেই সময়ের দাপুটে কর্তা এম এন দত্তরায়ের কথা। যিনি কলকাতার বুকে বেচু দত্তরায় নামেই ‘কুখ্যাত’। কারণ ইতিহাস বলছে চুনি থেকে পিকে কিংবা আর এক প্রয়াত ক্রিকেটার সমর চক্রবর্তী, কেউ না কেউ এম এন দত্তরায়ের চক্রান্তের শিকার হয়েছেন।
বড় আকর্ষণ সিনেমার পার্শ্বশিল্পীরাও। পিকের ভূমিকায় চৈতন্য শর্মা, চুনির ভূমিকায় চৈতি ঘোষালের পুত্র অমর্ত্য রায়, এবং নেভিল ডি’সুজার ভূমিকায় আরিয়ান ভৌমিক মনে বেশ দাগ কেটেছেন। এই তিন জনের অভিনয় ছবির একটা বড় আকর্ষণ। প্রত্যেকটি দৃশ্যে এঁদের অভিনয় দর্শককে প্রভাবিত করবে। অভিনেতাদের সঙ্গে খেলোয়াড়দের চেহারার গঠনগত মিল খুঁজে পাওয়াই এই ছবির সব থেকে বড় প্রাপ্তি। কিন্তু প্রশ্ন হল, তুলসীদাস বলরামের ব্যাকগ্রাউন্ড কিছুটা হলেও তুলে ধরা হলেও, অল্প বয়সে পিকের পিতৃহারা হওয়ার প্রসঙ্গ এলেও তাকে বিস্তৃতি দেওয়া হয়নি। একই ভাবে চুনির মতো কিংবদন্তির ‘ফ্ল্যামবয়েন্স ইমেজ’-কে দেখানো হল না। তবে এটুকু বাদ দিলে এই ছবি মুগ্ধ করবেই। এ আর রহমানের সঙ্গীত ‘ময়দানে’-র সম্পদ। বিশেষ করে খেলার মুহূর্তে আবহ সংগীতের ব্যবহার ‘ম্যাজিক’ তৈরি করে পুরোদমে। গানগুলিও বেশ ভাল।
সিনেমায় বেশ কিছু জায়গায় গবেষণা চোখে পড়েছে। তবে একইসঙ্গে খটকা লাগল এশিয়াডের দুটি ম্যাচের স্কোরলাইন দেখে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে লিগ পর্বের প্রথম ম্যাচে ভারত ০-২ গোলে হেরেছিল। অথচ সিনেমায় দেখানো হল ০-৪! ফাইনালের কথাই ধরুন। একাধিক সমস্যা ও স্থানীয়দের ব্যারাকিংয়ের মাঝেই আগাগোড়া সেই দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে দাপট দেখিয়েছিল ভারত। অথচ সিনেমায় দেখা গেল পেনাল্টি থেকে গোল পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু ইতিহাস তো সেটা বলছে না। ১৭ মিনিটে পিকে ব্যানার্জি গোল করার পর ২০ মিনিটে গোল করেন জার্নেল সিং। যদিও তিনি হেডে গোল করেননি। ৮৫ মিনিটে কোরিয়ার হয়ে ব্যবধান কমান চা-তে-সুং। কিন্তু সিনেমার ফাইনাল ম্যাচের সঙ্গে ইতিহাসের কোনও মিল নেই। যদিও বড় পর্দায় এত সুন্দরভাবে ফুটবল ম্যাচ তুলে ধরার জন্য সিজিআই এবং ভিএফএক্স-এর অবদান অনেক।
‘ময়দান’ ছবিটা পিকে, চুনি, অরুণ ঘোষের উদ্দেশে শ্রেষ্ঠ সম্মান। ছবির শেষ বড় আকর্ষণ ক্রেডিট লিস্ট। ২০১৮ সালে কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে পিকে-চুনির সঙ্গে দারুণ মন্তাজ শুট করা হয়েছিল। সেই দৃশ্য দেখে আপনারা কেঁদে ফেলতেই পারেন। সেই সময় পিকে এবং চুনি দু’জনেরই শরীর যথেষ্ট খারাপ। কিন্তু তা-ও তাঁরা পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন। তাই আপনি ক্রীড়াপ্রেমী হলে ‘ময়দান’ দেখুন। বারবার দেখুন।