নিজস্ব প্রতিনিধি : তিনি ভারতীয় ফুটবলের আইকন। ভারতীয় ফুটবলের সম্রাট বললেও কম বলা হবে। তবে এহেন চুনী গোস্বামী কিন্তু ক্রিকেটও বেশ দাপটের সঙ্গে খেলতেন। তাঁর অধিনায়কত্বে ১৯৭১-৭২ মরসুমে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে বাংলা রঞ্জি ফাইনাল খেলেছিল। তবে এখন আমরা অন্য একটা ম্যাচের কথা বলবো।
অতীতে বিদেশি দল ভারত সফরে এলে, রাজ্য দলগুলোর সঙ্গে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলত। রঞ্জি ট্রফি জয়ী দলের সঙ্গে বা আঞ্চলিক দলের সঙ্গে খেলা দেওয়া হত তাদের। ১৯৬৬'তে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এল, ওরা বিশ্বের এক নম্বর দল। আর সেই সময় ভারতের সব চেয়ে দুই দুর্বল আঞ্চলিক টিম ছিল মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল। তাই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের কর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সেই দুটি দলকে একত্র করে একটি দল গড়ল। যারা ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিল।
সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন হনুমন্ত সিং। সব মিলিয়ে সম্ভবত ছ’জন ছিল পূর্বাঞ্চল থেকে। তরুণ চুনী গোস্বামী, রমেশ সাক্সেনা, অম্বর রায়, সুব্রত গুহ, দেবু মুখোপাধ্যায় ও বিসিসিআইয়ের প্রখ্যাত চিফ কিউরেটর দলজিত সিং। সেই দল ইন্দোর পৌঁছানোর পর দেখা গেল একটি নামী ইংরেজি সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে ‘উইকেস্ট অপোজিশন টু ফেস মাইটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ (মহাশক্তিধর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে দুর্বলতম প্রতিপক্ষ)।
ইন্দোরের হোলকার স্টেডিয়ামে দুটো দলের জন্যই গ্রীন টপ অপেক্ষা করছিল। বড়দিন ও নিউ ইয়ারের আবহের মধ্যে শুরু হয়েছিল সেই ম্যাচ। যা নিয়ে প্রবল অসন্তুষ্ট ছিল ক্যারিবিয়ান দল। কারণ, সেই সময় কলকাতায় দারুণ নিউ ইয়ার পার্টি হত। সেই কারণে নতুন বছরের সময়টা ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম সব সময় কলকাতায় কাটাতে চাইত। সেই ক্যারিবিয়ান টিমে সবই তো ছিল পার্টি-ওস্তাদ। রাতভর নাচগান, পান করায় ডুবে থাকত। তবে এতে তাদের পারফরম্যান্সে কোনও প্রভাব পড়ত না। সারা রাত নিদ্রাহীন কাটিয়েও বাইশগজে কাঁপিয়ে দিতেন স্যার গ্যারি সোবার্স, রোহন কানহাই, ক্লাইভ লয়েড, ডেরেক মারে, ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ'রা। যদিও সোবার্স আর কনরাড হান্ট প্রস্তুতি ম্যাচটা খেলেনি।
শুধু তাই নয়। ইন্দোরের ম্যাড়ম্যাড়ে হোটেলে থাকা নিয়ে খুব অভিযোগ করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারেরা। কিন্তু ম্যাচের দিন ওদের রূপ একেবারে আলাদা। ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ ও লেস্টার কিং— তিন জন সেরা পেসারকে খেলিয়ে দিল। আর চুনীর দলের একমাত্র পেসার সুব্রত গুহ। দুই স্পিনার মহম্মদ সিদ্দিকি ও চাঁদু জোশী। দলে অন্য কোনও জোরে বোলার না থাকলেও, চুনী মিডিয়াম পেস বোলিং করতে পারতেন। স্টেট ব্যাঙ্কে একসঙ্গে চাকরি করা ও সেই দলের হয়ে খেলার সুবাদে হনুমন্ত সেটা জানতেন। বেশি জোর না থাকলেও ওঁর হাতে যে ভাল ইনসুইং আছে, সেটা জানতেন অধিনায়ক। মাঝেমধ্যে লেগকাটারও দিতে পারতেন চুনী। টসে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথমে ব্যাট করল। মাঠ ভর্তি দর্শক। কিন্তু সুব্রত আর চুনীর বল এমনই সুইং করতে শুরু করল যে, ক্যারিবিয়ান মহারথীরাও ব্যাকফুটে। ১৩৬ রানেই প্রথম ইনিংস শেষ হয়ে গেল ওদের।
চুনীর মিডিয়াম পেস সুইং ও সিম বোলিংয়ে নাকানিচোবানি খেয়েছিল বিশ্বসেরা দলের সব ব্যাটসম্যানেরা। কানহাই মাত্র ৪ রান করে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন। তাঁকে ফেরান চুনী। প্রথম ইনিংসে চুনী ৪৭ রানের বিনিময়ে ৫ ও সুব্রত গুহ নিল ৪ উইকেট নিয়েছিলেন।
তবে হনুমন্তের দলের ব্যাটিংও ভাল হয়নি। খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় ক্যারিবিয়ানদের আবার বেগ দিলেন সুব্রত আর চুনীর জুটি। ৪৪ রান যোগ করেছিলেন ওঁরা। ৫ উইকেট নেওয়ার পরে ২৫ রানও করলেন। যার জন্য ৯ উইকেটে ২৮৩ রান তুলে ডিক্লেয়ার করে দিলেন হনুমন্ত। ১৪৭ রানে এগিয়ে গেল তাঁর দল। দ্বিতীয় ইনিংসেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিং সুব্রত-চুনীর সুইংয়ের সামনে ধরাশায়ী হল। শেষের দিকে হল আর লেস্টার কিং মিলে এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়ে রান তুললেও, ইনিংসে হার আটকানো যায়নি। দুরন্ত ব্যাটিং-বোলিংয়ের পাশাপাশি সেই ম্যাচে দারুণ ফিল্ডিং করে সবার নজর কেড়েছিলেন সদ্য প্রয়াত লেজেন্ড। দ্বিতীয় ইনিংসে সুব্রত নিলেন সাত উইকেট। চুনীর ঝুলিতে তিন শিকার। ফলে ১০৩ রানে ওদের শেষ করে দিয়ে হনুমন্তের দল সেই ম্যাচ ইনিংস ও ৪৪ রানে জিতেছিল।
এই দুই বাঙালি জাতীয় দলে সুযোগ পাননি। তবে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে আজীবন অমর হয়ে থাকবে সুব্রত-চুনীর অসাধারণ পারফরম্যান্স এবং শক্তিশালী ক্যারিবিয়ানদের হারিয়ে সেই জয়। লয়েড-লেস্টার কিং'দের হারিয়ে সেই ম্যাচের পর হনুমন্তের সতীর্থরা পার্টি করেছিল।
তবে এর চেয়েও আকর্ষণীয় ব্যাপার হল সেই ম্যাচে আরও একটা মজার ব্যাপার ঘটেছিল। চুনী নাকি মাঠের মধ্যে নিজেকে নিজে উদ্বুদ্ধ করতেন। বলতেন "কাম অন চুনী, তুমি এটা পারবে। তুমি চ্যাম্পিয়ন।" ভাবলেও অবাক লাগে। একজন দুর্দান্ত ফুটবলার, যিনি স্রেফ মজার জন্য ক্রিকেট খেলে সীমিত দক্ষতা নিয়েও সর্বোচ্চ লেভেলে পারফর্ম করেছেন।