অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়, কাতার : পিট হুবারস এখনও আইএসএলের এর গ্রাস রুট ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কিনা জানা নেই। কিন্তু একেবারে প্রথম বছরেই উয়েফা থেকে তাকে নিয়ে এসেছিল রিলায়েন্স। তার আগের ৩০ বছর উয়েফার সঙ্গে গ্রাস রুট লেভেলে কাজ করেছিলেন হুবারস।তাঁকে দায়িত্বে রেখেই আইএসএল-এর গ্রাস রুট প্রোগ্রাম সাজাতে চেয়েছিলেন নীতা আম্বানির টিম। কলকাতার এক মিটিং-এ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। আমার প্রশ্ন ছিল, প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ভারতীয় ফুটবলে লক্ষ্য করেছি অনূর্ধ্ব ১২- ১৪ পর্যায়ে আমাদের ছেলেরা বিশ্বের যে কোন দেশের সঙ্গে এক মানের ফুটবল খেলে, কিন্তু যত বয়স বাড়তে থাকে ততই গ্যাপটা বাড়তে বাড়তে আকাশ ছোঁয়া হয়ে যায়। এটার কারণ কী ? উদাহরণ হাতের কাছে মজুদ ছিল, টাটা ফুটবল একাডেমিতে গৌতম ঘোষ, চন্দন দে, অলক দাস, কার্লটন চ্যাপম্যানদের সময় কতবার লন্ডন ফুটবল ফেস্টিভ্যালে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখেছি। কলকাতা মেয়রস এগারোর অরিন্দম দেব, জয়ন্ত সেনদের দেখেছি ডানা কাপ, গোথিয়া কাপ জিতে আসতে। চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরত ওরা। আন্ডার এজের টুর্নামেন্ট হিসেবে এই প্রতিযোগিতাগুলোর সুনামই আছে। তাহলে বড় হলেই তফাৎটা কোথায় হয়? হুবারস বলেছিলেন তফাৎ হয়, ওই টুর্নামেন্ট গুলোর পর তোমরা এই ছেলেদের আর ওই লেভেলের কম্পিটিশন দিতে পার না। এই যে ট্যালেন্টদের
তোমরা স্পট করলে, তাদের তো খেলতে হচ্ছে অনেক কম মানের ফুটবলারদের সঙ্গে। পাঁচ গোল, সাত গোলে জিতছে। তোমরা ভাবছো দারুন এগোচ্ছে। আসলে তা নয়। তোমাদের এখানে যেহেতু অনেক একই মানের প্রতিভা নেই, তাই ওরা কম্পিটিশনটাই ফেস করছে না, ফলে এদের কোনরকম ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে না ভবিষ্যতে। প্রতিভাবানদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে ছোট থেকেই প্রতি মুহূর্তে টাফ কম্পিটিশন দরকার দরকার। কিন্তু পাব কোথায়! উপায় একটাই। কোয়ান্টিটি বাড়িয়ে কোয়ালিটি ফুটবলারের সংখ্যা বাড়ানো! না হলে জাপান মডেল অথবা মডেল মরক্কো! মরক্কোর ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। আমাদের দেশে দ্বৈত নাগরিক বৈধ নয়। সুতরাং বিদেশ থেকে প্লেয়ারস অফ ইন্ডিয়ান অরিজিনদের নিয়ে এসে ভারতের জার্সি পরিয়ে খেলানোর আলোচনা সেই ৯০ দশকের শেষেরদিক থেকে শুরু হয়েছিল। যখন মাইকেল চোপরা, হরপাল সিংরা ইংল্যান্ডে লিডস ইউনাইটেড এর মতো ক্লাবে খেলছেন। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন সেই সময় একটা তালিকাও তৈরি করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ পাসপোর্ট ছেড়ে কেউ ভারতের নাগরিকত্ব নিতে রাজি ছিলেন না তাঁরা কেউ! যেটা পরবর্তীকালে আরাতা ইজুমি রাজি হন। ভারতের জার্সিও গায়ে চাপান। মরক্কোর ক্ষেত্রে সুবিধা হল, আশরাফ হাকিমি থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটা খেলোয়াড় জন্মগ্রহণ করেছেন ইউরোপে। হাকিমির কথাই ভাবুন না, জীবিকার সন্ধানে বাবা-মা মরক্কো ছেড়ে স্পেনে থাকলেন । মা লোকের বাড়িতে অফিসে মেঝে পরিষ্কারের কাজ করতেন আর বাবা ছিলেন রোডসাইড হকার। সেখান থেকে ছেলে খেললো চেলসিতে কিন্তু মরক্কোর নাগরিকত্ব ছাড়েননি হাকিমি। জাতীয় দলের জার্সি চাপালেন মরক্কোর হয়ে। মরক্কোর কোচ রেগ্রাগুই-এর টিমের ২৬ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ১৪ জনই এমন বিদেশে জন্ম আর বড় হওয়া। তাঁর নিজেরও জন্ম ফ্রান্সে কিন্তু খেলেছেন মরক্কোর হয়ে। আর কোচ হিসেবে তাকে আফ্রিকার হোসে মোরিনহো ভাবা হয়। মাত্র তিন মাস দায়িত্ব পেয়েছেন। তাতেই চমকে দিয়েছেন।
প্রথমবার কোচ হয়েছিলেন মরক্কোর ফুস রাবাদ ক্লাবের। লিগ টেবিলের মাঝখান থেকে রাবাতকে চ্যাম্পিয়ন করান। মাঝে কিছুদিন কোচ হয়েছিলেন কাতারের আল দাহিলের। বিশ্বকাপে এই ক্লাবের মাঠেই এবার অনুশীলন করছে মরক্কো। স্বাভাবিক কোচের চেনা মাঠ, পরিবেশ, সাহায্য তো হবেই। তবে একইসঙ্গে মরক্কো ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনও একটা দীর্ঘ মেয়াদি প্ল্যান নিল। এবং সেটা দশ বছর আগেই। রাবাতের কাছে সেল বলে একটা জায়গায় একাডেমী তৈরি করল সরকার আর মরক্কো ফুটবল সংস্থা। রাজা নিজে প্রচুর সাপোর্ট করলেন। তাঁর নামেই হলো একাডেমি। মহম্মদ সিক্স ফুটবল একাডেমি এই যে সেভিয়ার ফরোয়ার্ড ইউসেফ এন নাসিরি কিম্বা অঞ্জার্সের আবেদিন ও আউনাহি কিংবা ওয়েস্টহ্যামের সেন্টার ব্যাক নায়েখা আগুয়ের্ডদের দেখছেন। এরা কিন্তু আবার দেশজ প্রোডাক্ট। এই অ্যাকাডেমির স্টুডেন্ট। বাকিরা প্লেয়ার্স অফ মরক্কান অরিজিন। আপনাকে এই সময়ে সাফল্য পেতে হলে এই ফর্মুলাতেই খেলতে হবে। ইউরোপের প্রথম সারির লিগগুলো থেকে ফুটবলার খুঁজতে হবে কিংবা নিজেদের ফুটবলারদের খেলাতে হবে বিদেশি লিগগুলোতে। জাপানি সাংবাদিক ফুনাকির সাথে দেখা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন, "নাকাতার ইপিএল-এর সাফল্যটা আসলে আমাদের ফুটবল বদলে দিল। এই যে আমাদের ফুটবলাররা বিশ্বের যে কোনও টিমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলছে, তার কারণ হচ্ছে এখন বিদেশি লিগের দরজাগুলো আমাদের দেশের ফুটবলারদের জন্য খুলে গিয়েছে। এই যে জার্মানিকে আমরা হারালাম, কোন অঘটন নয়। আমাদের সাতজন ফুটবলার বুন্দেশলিগায় নিয়মিত খেলে।"
নিশ্চিত থাকুন, আগামী দিনে ফুটবল বিশ্বে আর চমক বলে কিছু থাকবে না। ক্রোয়েশিয়ার সাফল্যকে কি চমক বলবেন? ১৯৯১ এ ক্রোয়েশিয়া স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণার আগে আটবার বিশ্বকাপ খেলেছে যুগোস্লাভিয়া। কত বড় বড় দলকে হারিয়েছে। সেই দেশেরই তো ক্রোয়েশিয়া। ফুটবল কৌলিন্য, পরম্পরা কোথায় পিছিয়ে! এই একই ফুটবলাররা তো খেলছেন রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা অন্য কোথাও। তাহলে চমক, অঘটন বলব কেন! বরং দিন দিন কঠিন হয়ে যাবে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মত পাউয়ারহাউসদের কাজ। লাতিন আমেরিকার এই দলগুলো আগে যখন খেলতে আসত, তখন দু'একজন ছাড়া বাকিদের বেশিটাই থাকতেন আনকোরা, স্থানীয় লিগের আবিষ্কার। বিশ্ব ফুটবলে তাদের আবির্ভাব হত বিশ্বকাপের মাধ্যমেই। পেলে, গ্যারিঞ্চাদের কোনদিন ইউরোপের লিগে খেলতে হয়নি। এখন অ্যান্টনি, রড্রিগো, রিচার্লিসনরা এক মরশুম ভালো খেললেই তাদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন বিভিন্ন ক্লাবের এজেন্টরা। বিশ্বকাপে দেখার আগেই তাদের দেখে নেয় ফুটবল বিশ্ব। তাই 'নভেলটি' ফ্যাক্টরটা যেমন থাকে না, তেমনই পিছিয়ে পড়া দেশের ফুটবলাররাও নিজেদের তৈরি করে নেওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। পিট হুবারসের কথা মত, "কম্পিটিশন, কম্পিটিশন। ওটাই আসল। ওটাই আসল সোনাকে বার করে আনে।"
নিশ্চিত থাকুন, এই ব্যবধান আরও কমবে। আর কোনও অঘটন থাকবে না ফুটবল বিশ্বে। ব্যবধান যে কমছে, উপলব্ধি করছে ফিফাও। ২০২৬ বিশ্বকাপেই তাই নিয়ে আসছে ৪৮টা দলকে। দেড় মাসের টুর্নামেন্ট। ৪৮টা দেশের। আফ্রিকা, এশিয়া সবের দল বাড়বে। এই কয়েকদিন ফিফার টেকনিকাল স্টাডি গ্রুপের তিনটি সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির ছিলাম। ক্লিন্সম্যান, সানডে ওলিশের মত প্রাক্তন কিংবদন্তীরা উচ্ছ্বসিত এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে। সত্যিই তো, যেমন খেলার মান, তেমন চমক। আর কিন্তু বিশ্বকাপ একতরফা হবে না। ফিফার গ্লোবাল ডেভেলপমেন্টের চিফ আর্সেন ওয়েঙ্গার সেদিন বলে।গেলেন, এটাই সেরা সময়। আগামী বিশ্বকাপ থেকেই লড়াই আরও বাড়বে, নিশ্চিত থাকুন। ভারত কি এবারও ঝাঁপাবে না! এশিয়ার দলের সংখ্যা চার বছর পর অনেকটা বেড়ে যাবে। এরপরেও নয়! কাজটা কঠিন ছিল না! এশিয়া মানে এখন ১০ এ থাকতে হত। তারপর তো যে কেউ যোগ্যতা পেতে পারে! আর ১৩০ কোটির আবাদির জন্য ফিফাও দু-হাত বাড়িয়ে তৈরি। দেখা যাক, কল্যাণ-সাজিরা কতটা পারেন!