ক্রীড়া সাংবাদিকতার এক বিস্মৃত আর্মি জেনারেল

অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়: গুড বাই ধীমানদা। আর থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ। আশা করি, এবার আপনি ঘুমোবেন, শান্তিতে ঘুমোবেন। বাকি সময়টা তো ছটফটানি আর অবিরাম দৌড়ে কেটে গেছে। নিজের চেয়ার থেকে অশোকদার চেয়ার অবধি নিজে দৌড়েছেন আর ছুটিয়ে বেরিয়েছেন একদল ক্ষুধার্ত সাংবাদিককে। নিজে বাড়ি থেকে আজকালের বাইরে কোন রাস্তা চিনলেন না, অথচ পৃথিবী দেখার সুযোগ করে দিলেন বহু মানুষকে। তারা মহীরুহ হল। আপনি অন্তরালেই থাকলেন। নিজের ওরকম সোনার কলম, তুলে রাখলেন অন্যকে দিয়ে ভালো লেখাবেন বলে।
অশোক দাশগুপ্তকে ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। দেখেছি আপনাকে। দেখেছি, পূর্বসূরির প্রতি কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা, দায়বদ্ধতা, শ্রদ্ধা, সম্মান নিয়ে একজন মানুষ তাঁর দেখানো রাস্তায় হাঁটতে পারে। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে কোন বস, কোন শিক্ষক, কোন নেতা এমন আনুগত্য পেলে নিশ্চয়ই নিজেকে সৌভাগ্যবানই ভাববেন। আপনি কী পেলেন? জানিনা। কিন্তু আমার মত আপনার কাছে "লেফট রাইট ঝাড় খাওয়া" সেদিনের শিক্ষানবিশ সাংবাদিকের মনও এই যে মেঘলা আকাশের মত হয়ে আছে, আপনার উত্তরসূরী ক্রীড়া সম্পাদক, যিনি আপনার চেয়ারে বসে ক্রমাগত হাহুতাশ করে যাচ্ছেন, আজকাল ক্রীড়া দপ্তরের অফিস বয় যারা, তাদের চোখে জলের ধারা- আপনার পাওনা এগুলোই ধীমানদা।
আজকালের স্পোর্টস কভারেজ সবচেয়ে ভালো। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এই ভাবনা, এই স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে এই কাগজ। দেবাশিস দত্ত, সরোজ চক্রবর্তী, অরুণ সেনগুপ্ত, অরূপ বসু, সুমন চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ সাধু, পার্থ রুদ্র, মুনাল চট্টোপাধ্যায়ের নাম সবাই শুনেছে। কিন্তু নেপথ্যের মানুষটাকে কেউ জানতে পারেনি। কে জোঁকের মত লেগে থেকেছে প্রতিটা সাংবাদিকের পিছনে, কে সকাল থেকে ফোনে ফোনে ফলো আপের পর ফলো আপ করে গেছে দিনের পর দিন, কে এই সেরার দৌড়ে নিজের ঘোড়াদের নামিয়ে অদৃশ্য একটা চাবুক ঘুরিয়ে গেছে অন্তরালে থেকে, কেউ জানেনি। হ্যাঁ বিশ্বাস করুন, চাবুকই। কথার চাবুক। দ্বিতীয় হওয়ার কোন অপশনই নেই। প্রথম হতে হবে। সেরা খেলার পাতাটা আজকালেরই হতে হবে। না হলে "মানে মানে" জিজ্ঞেস করে পাগল করে দেবেন আপনি।
রীতিমতো একঘেয়ে, বাতিকগ্রস্ত এবং কাজপাগল একটা লোক। আপনি ডিপার্টমেন্টে না থাকলে আমাদের চর্চার একটা বড় সাবজেক্ট আপনি। "বৌদি কী করে সহ্য করে এই লোকটাকে!" মাঝে মাঝে সত্যিই তো সব সহ্যের বাইরে চলে যেতেন। খবরের জন্য কোন যুক্তি আপনি শুনবেন না।
১৯৯৪ বিশ্বকাপে প্রথমবার আজকাল স্পোর্টস বিভাগে কাজ করতে গিয়ে শুনলাম, আপনি সফররত সাংবাদিককে অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছেন, মাঝরাতে ব্রাজিল ক্যাম্পে ঢুকে পড়তে কিংবা পেলের হোটেলে ঢুকে প্রতিক্রিয়া নিতে। অবাক হতাম। এরকমও হয়। সফররত সাংবাদিক এক দুবার তর্ক করে রণেভঙ্গ দিয়েছেন। বুঝে গেছেন, ঢুকতে না পারলেও তাঁকে ওই মাঝরাতেই ব্রাজিল হোটেলের বাইরে পৌঁছাতেই হবে। না হলে কয়েক হাজার মাইল দূরেও জিনা হারাম করে দেবেন আপনি। কলকাতায় কোন বিখ্যাত ক্রিকেটারের আগমন। হোটেলে আছেন। আপনার নির্দেশ এসেছে, ২৪ ঘন্টা ওই হোটেলের বাইরেই থাকতে হবে। কষ্টকর ছিল, দাঁত কামড়ে পড়ে থেকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দায় ছিল, কিন্তু এই লেগে থাকার শিক্ষাটাই সাংবাদিক তৈরি করে দিল আমাদের মত কয়েকজনকে।
সেদিন ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবে মুকুল দত্ত স্মৃতি কর্মশালায় এই কথাগুলোই বলেছিলাম। জানিনা, হুইলচেয়ারে বসে থাকা আপনি বুঝতে পেরেছিলেন কিনা। আজ আবার এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশও জানি আপনি শুনতে পাবেন না। তাতে কিছু যাওয়া আসার নেই। বাংলার মানুষ অন্তুত জানুক, আজকালের সেরা খেলার পাতার নেপথ্যের মানুষটা কে! আজকালে আমার চাকরিটা পাকা হয়নি ধীমানদা। যখন বললেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক অভিযোগ, অভিমান নিয়ে আমিও আজকাল ছাড়তে পারতাম। পারিনি, কারণও বোধহয় আপনি। জানতাম, এই লোকটার চেষ্টায় কোন খাদ ছিল না। কোন স্বার্থপরতা ছিল না। প্রতিহিংসা ছিল না। লোকটা এখনই বকে কাঁদিয়ে দেবে। আবার ভুলেও যাবে। কালই হয়ত অন্য কারণে বকবে। কিন্তু প্রয়োজনে পাশে দাঁড়াবে। অশোকদার ঘরে গিয়ে সবার হয়ে বকুনিটা নিজে খেয়ে আসবে, কাউকে বুঝতে দেবে না। ভালো স্টোরি হলে মুখে কিছু বলবে না, চাপা একটা হাসি লুকাবে। কপির শুরুতে আজকালের প্রতিবেদনটা কেটে নিজের হাতে লিখে দেবে সাংবাদিকের নাম। বাই লাইন। ছোট ছোট অক্ষরে আপনার হাতের ওই লেখাটা খুব মনে পড়ছে ধীমানদা।
মনে পড়ছে অনায়াসে কীভাবে ৫০০ শব্দের কপিকে ২০০ শব্দ করে দিচ্ছেন। এতটুকু তথ্য বাদ না দিয়েও। কাটাকুটির ওই পাতাগুলো আমাদের শেখার সহজ পাঠ। সেগুলোই ফলো করে গেছি, বিশ্বাস করুন। নোটিশ বোর্ডে টাঙানো সেই অ্যাসাইনমেন্ট লিস্টটা, গাভাসকারের সেই বড় কাট আউটটা, আপনার কাঁচের টেবিলটা, স্পোর্টস রুমের সেই লম্বা টেবিল, অন্য প্রান্তে টিভি, সেখানে কালো কাপড় মুড়িয়ে ছবি তুলছে শঙ্কর নাগ দাস। আপনি যাতায়াতের পথে টিভি দেখে দাঁড়িয়ে গেছেন। ফিরে এসে ঘোষণা করছেন, "এই এসি বন্ধ করো!" গরমকালেও যাঁর গলায় মাফলার আর সারা বছর গরম জলে গার্গল। কত কত স্মৃতি। কত রাত একসাথে কাটিতে দেওয়া। খেলার দুনিয়ার সব খবর পাঠকদের জানিয়ে পরদিন সকালের গরম কাগজ প্রেস থেকে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছি আমরা। মাঝের সময়টায় ডেডলাইনের সঙ্গে যুদ্ধ চলেছে। কখনও কাজের ফাঁকে গল্প হয়েছে। অনেক গল্প।
অনেক গল্প নিয়ে চলে গেলেন আপনি ধীমানদা। আজকাল স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের ফেভারিট গল্প সেসব। কোনটা ফ্লাইওভারের হাইট মাপার গল্প, কোনটা ট্রেন যাত্রায় রিজার্ভড সিট খোঁজার গল্প, কোনটা আবার অফিসে ক্রিকেটে ব্যাট মোছার গল্প। সেসব গল্পগুলো একান্ত আমাদেরই থাক। বাংলা ক্রীড়া সাংবাদিকতার আগামীর সব প্রজন্ম বরং চিনুক, এক একরোখা, গন্তব্যে স্থির এক আর্মি জেনারেলকে। কাজের জায়গাটা যাঁর কাছে ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের মত।
অনেক কৃতজ্ঞতা ধীমানদা। শেষবারের মত। ভালো থাকুন। আপনার মারাদোনা, অরুণ, পার্থ সবাইকে নিয়ে ভালো থাকুন।