অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়, কাতার : স্কালোনি সবে সাংবাদিক সম্মেলন সেরে গেছেন। লুসাইল স্টেডিয়ামের প্রেস কনফারেন্স রুমে জার্নালিস্টরা ব্যাগপত্র গুছিয়ে মিডিয়া সেন্টার অভিমুখী তখন হঠাৎ শোনা গেল, মেসি আসছেন। সবাই আবার যে যার জায়গায়। মেসি এলেন। মুখে চেনা, পরিচিত হাসি নেই। বরং বিরক্ত, রাগে ফুঁসছেন। বিশ্বাস করুন, মেসিকে এইভাবে আগে দেখিনি। এসেই বললেন, "রেফারির এই ম্যাচ অফিশিয়েট করার মত যোগ্যতাই নেই।" বলেন কী! কাকে শুনছি! এতো তিন দশক আগে একটা লোক এইভাবে মাঠে বাঁশি হাতে, কালো জামা পড়া লোকের বাপবাপান্ত করে শেষ করে দিয়েছিলেন। এত ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা জমিয়ে রেখেছিলেন যে জীবনের শেষদিন অবধি ১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনালের রেফারি এডগার্ডো কোডেসাল সম্পর্কে বলে গেছেন, "ওই লোকটাকে ফিফা পাঠিয়েছিল আমাদের বিরুদ্ধে ডাকাতি করতে।" আর কোডেসাল মেক্সিকোতে থাকতেন বলে মারাদোনার ডিকশনারিতে মেক্সিকো মানেই 'ল্যান্ড অফ থিভস' অর্থাৎ চোরদের দেশ! কিন্তু ৩২ বছর পর লুসাইল স্টেডিয়ামের নীল-সাদার ১০ নম্বরের মুখে এ কি শুনছি! পরিষ্কার বলছেন, "এই রেফারি আমাদের ক্ষতি করতে এসেছিল।" না, ফিফার শাস্তির কোনও ভয় নেই, নিজের ব্র্যান্ড ইমেজের যে বিতর্কহীন, পরিচ্ছন্ন পজিশনিং আছে, তা নিয়েও যেন বেপরোয়া। একেবারে যেন অন্যরকম। আর্জেন্টিনার সাংবাদিকরা বলছেন, এই যে নতুন মেসিকে দেখছেন, এটাই আসল এখন। মেসির এই যে মারাদোনীকরণটা দেখছেন, আর্জেন্টিনার এই সাফল্যের দৌড়ের কারণও সেটা। যেটা শুরু হল ২০১৯ এর কোপা আমেরিকায়। ২০১৮ এর রাশিয়া বিশ্বকাপের ভরাডুবির পর আর্জেন্টিনার ফিরে আসার লড়াইটা শুরু হয়েছিল পরের বছর কোপায়। কিন্তু সেখানেও ফাইনালে ব্রাজিলের কাছে ২-০ ফলে হারল আর্জেন্টিনা। ম্যাচের পর সোজা রেফারির বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করলেন মেসি। ম্যাচ শেষে বললেন, "আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে খেলাতে এসেছিল।" চিলির সাথে কোয়ালিফাইং ম্যাচে ঠিক এক গন্ডগোল। ব্রাজিলিয়ান রেফারিকে দেখেই বিগড়ে গেলেন। আর্জেন্টিনা ম্যাচটা ১-০ এ জিতল, কিন্তু মেসি সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছন, "মনে হচ্ছিল রেফারি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে আজ খেলাতে নেমেছিল।" রেফারিকে নিয়ে বিতর্ক, অভিযোগ - এসব মেসির জীবনে নতুন কিছু নয়, কিন্তু সেটা ছিল ক্লাব পর্যায়ে। বার্সিলোনার হয়ে খেলার সময়ে এক রেফারির সঙ্গে টানেলে তর্কাতর্কি করেন। আরও অনেক কিছু। কিন্তু এসবগুলো সবটাই মূলত বার্সিলোনার হয়ে। আর্জেন্টিনা মেসি তো তখন জাতীয় সঙ্গীতেও গলা মেলাতেন না। ২০১৮ বিশ্বকাপের ব্যর্থতা বোধহয় নতুন করে ভাবতে শেখাল। বোঝালো, আর্জেন্টিনার হয়ে ভালো কিছু করার ক্ষেত্রে দুটি গন্ডিকে টপকাতে হবে। এক, মারাদোনার ছায়ার সঙ্গে অবিরাম তুলনার পাহাড় প্রমাণ চাপটা কাটাতে হবে। দুই, এই চাপ কাটাতে পারে একমাত্র মারাদোনার ভূমিকায় অভিনয় করে যেতে পারলে। অর্থাৎ শুধু আর্মব্যান্ড পরে ক্যাপ্টেন্সি নয়, এবার চাই লিডারশিপ। রীতিমত, অ্যানিমেটেড লিডারশিপ। ২০১৯-ই তাই নীল-সাদা জার্সিতে নতুন মেসিকে দেখল। ২০১৯ এ অবশ্য সাফল্য আসেনি, কিন্তু ২০২১ এ এল কোপা আমেরিকা।
মেসির বায়োগ্রাফিতে মা সেইলা একটা গল্প বলেছিলেন। সেইলারা দুই বোন ছিলেন। সেইলা আর মার্সেলা। সেইলার তিন ছেলে। মার্টিয়াস, রডরিগো আর লিও। মার্সেলার দুই। ম্যাক্সিমিলিয়ানো আর এমানুয়েল। এই ম্যাক্সিমিলিয়ানো খেলতেন প্যারাগুয়ের অলিম্পিয়া ক্লাবে। এমানুয়েল খেলতেন স্পেনেরই ক্লাব ফুটবলে। ছোটবেলা থেকে মেসির অভিন্ন হৃদয় বন্ধুও ছিলেন এমানুয়েল। ছোটবেলায় প্রতি রবিবার দিদার বাড়িতে গেলে ভাইদের মধ্যে ফুটবল খেলা হত। সেইলা বলছেন, লিও প্রায় প্রতিবার বাড়ি ফিরত কাঁদতে কাঁদতে। সঙ্গে অভিযোগ, দাদারা তাকে জোর করে হারিয়ে দিয়েছে। এই নরম, লাজুক, স্বল্পভাষী মেসিই আস্তে আস্তে বড় হল। রোজারিও থেকে বার্সিলোনা অ্যাকাডেমিতে পৌঁছলেন। আর্জেন্টিনা জার্সি গায়ে উঠল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সাথে খেলা শুরু হয়ে গেল। তাঁর নাম দিয়েগো মারাদোনা। আর্জেন্টিনিয়ানদের ভগবান। মেসির তুলনাটা শুরু হয়ে গেল মারাদোনার সঙ্গে। মেসি যখন খুব ছোট, মারাদোনার সাথে একবার দেখা করার সুযোগ হয়েছিল মেসির মায়ের। মারাদোনার ফ্যান ছিলেন। দেখা হতে বলেছিলেন, "আমার ছেলেও ফুটবল খেলে। আশা করি, একদিন আপনার মত বড় ফুটবলার হয়ে উঠতে পারবে। আপনার কোচিংয়ে খেলতে পারবে।" সবটা সত্যি হয়েছে, কিন্তু মেসিও এত বড় হয়ে গেলেন যে সারাজীবন মারাদোনা ঐ অদৃশ্য প্রতিপক্ষটাই হয়ে গেলেন। সমস্যাটা শুরু হল ২০০৭ সালে বার্সিলোনার হয়ে গেটাফের বিরুদ্ধে একটা গোল থেকে। অদ্ভুতভাবে যেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার গোলের জেরক্স কপি। ঠিক মাঝমাঠের একটু আগে থেকে ডানদিকে বল ধরল বাঁ পায়ের এক ফুটবলার। দৌড় শুরু করল। শুরুতেই একজনকে ড্রিবল। দ্বিতীয়জনকে গতিতে পরাস্ত করল। তারপর বক্সের মধ্যে গোলকিপার সহ তিনজন ফুটবলারকে কাটিয়ে ডানপায়ে প্লেসিং। শুধু তাই নয়, গোলের সেলিব্রেশনটাও একইরকম। প্রশ্নটা উঠে গেল তখনই। আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ফুটবল ধারাভাষ্যকার ভিক্টর হুগো মোরালেস বললেন, "মেসি, আসলে তুমি কে? কোন গ্রহ থেকে এসেছো?" স্প্যানিশ একটা ব্যান্ড গান তৈরি করল, "বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার এক বছর পর নতুন তারকা জন্মাল। নতুন স্বপ্নের শুরু হল।" আর্সেন ওয়েঙ্গার থেকে এটো সবাই বললেন, "এসে গেছে ভবিষ্যতের মারাদোনা।" লিওকে ঘিরে সেই স্বপ্নটা ১৫ বছর ধরে লালন করছে আর্জেন্টিনা। আর কেরিয়ারের শুরুতেই মারাদোনার সাথে তুলনা, মারাদোনার সাথে সাদৃশ্য খোঁজার পুরো অধ্যায়টাই প্রবল চাপ বাড়াল মেসির।
এতদিন এই চাপটা ঘাড়ে নিয়েই খেলেছেন মেসি। এবারটা একটু অন্যরকম। স্ট্যান্ডে নেই মারাদোনা। নেই প্রতিটা মুহুর্ত তাকে মারাদোনার উচ্চতায় মেপে নেওয়ার চেষ্টা। তাই এই মেসি একেবারে অন্যরকম। নিজেকে বদলে ওই মারাদোনার মতই অ্যাগ্রেসিভ হয়েছেন, সমর্থকদের সাথে যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন। মাঝের বেশ কিছু সময়, আর্জেন্টিনা সমর্থকরা ভাবতে আরম্ভ করেছিলেন, আর্জেন্টিনার হয়ে লিওনেল মেসি যতটা না তাদের, তার থেকে বেশি স্পেনের। দলের ব্যর্থতা আর মেসির আরও খোলসে গুটিয়ে যাওয়া টিমের সঙ্গে সমর্থকদের দুরত্ব বাড়াচ্ছিল। এবার আর্জেন্টিনাকে দেখলেই বোঝা যাবে, সমর্থকদের সাথে তাদের অন্যরকম কেমিস্ট্রি। প্রতিটা ম্যাচের পর গ্যালারির দিকে যাচ্ছেন। সমর্থকদের সাথে অবশ্যম্ভাবী নাচ করছেন দল বেঁধে। মেসি নিজে অংশগ্রহণ করছেন সেই নাচে। প্রতিপক্ষ কোচকে রীতিমতো ভেংচি কেটে আসছেন। কয়েক বছর আগে দুঃস্বপ্নেও কি ভাবা যেত এসব!! তাই নীল-সাদা গ্যালারিও প্রতি ম্যাচে যেন উপচে পড়ছে। অবিরাম গান গাইছে তারা, ড্রাম বাজাচ্ছে।
১৮ ডিসেম্বর (কাতার সময় অনুযায়ী) মাঝরাত অবধি এই ড্রাম বাজবে কিনা এখন সময় বলবে। সেমিফাইনালের পর্ব থেকে সবটাই ট্র্যাপিজের দড়ির উপর হাঁটার মত। অবশ্য এটা বিশ্বকাপের মত টুর্নামেন্টের নকআউট স্টেজ থেকেই শুরু হয়ে যায়। তবু সেমিফাইনাল পৌঁছনো মানেই স্কিল, প্রতিভা, প্রস্তুতির একটা সঠিক মূল্যায়ন। এখন মারাদোনা 'সাজা' থেকে মারাদোনায় উত্তরণের মাঝে শুধু দুটো সিঁড়ি বাকি! বাকিটা সময় বলুক।