রণজিৎ দাস: মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব আইলিগ জিতে সামনের মরশুমে আইএসএলে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো।মহামেডান স্পোটিং ক্লাবের এই জয়ে বাংলার ফুটবলে নতুন দিগন্ত খুলে যেতে পারে।মহামেডান ক্লাবের আইলিগ জয়ের ক্ষেত্রে কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।একঝাঁক অনামী ফুটবলারদের নিয়ে টানা ১১টা মাস এভাবে সাফল্যের মধ্যে থাকা মুখের কথা নয়।প্রথমে কলকাতা লিগে তারা চ্যাম্পিয়ান হয়।তারপর ডুরান্ড কাপে ভালো পারফরম্যান্স করেছে।এবং আইলিগের এই ঐতিহাসিক জয়।
অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে যেমন মহামেডান ক্লাবকে এবছর যেতে হয়েছে। তেমনিই অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত তাদেরকে নিতে হয়েছে। দর্শকশূন্য মাঠে হোম ম্যাচ খেলার সিদ্ধান্ত সবচাইতে বেদনাদায়ক ছিল। কলকাতা লিগে আর্মি রেড দলের বিরুদ্ধে নৈশালোকের উত্তেজনাপূন্য ম্যাচে শেখ সিরাজউদ্দিনের হৃদয়বিদারক মৃত্যুকে পর্যন্ত সইতে হয়েছে। আইলিগের প্রস্তুতিতে কলকাতা লিগের চ্যাম্পিয়ানশিপের খেলাতেও নিজেদের অবস্হানে দৃঢ় থাকা আরও কঠিন ছিল। কলকাতা লিগের সেরা প্লেয়ারকে নিয়েও দলবদলের জন্য টানাটানির মধ্যে পড়তে হয়েছে। কলকাতা লিগের ভারতীয় ফুটবলারদের প্রতি বিশ্বাস রেখে আইলিগে খেলতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বিদেশি ফুটবলারদের স্কোয়াডে মুন্সিয়ানা ছিল। ব্যাঙ্কারহিলের মত স্পনসর পাশে থাকায় অনেক কঠিন কাজ সহজ হয়েছে। কিন্তু সাফল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রয়োজন হয়। ক্লাব প্রশাসন দৃঢ়ভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করেছে। খেপের মাঠের অযাচিত ঘটনাকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা গেছে। ক্লাবের পরিবেশটাই বদলে গেছে। দীপেন্দু বিশ্বাসের মত প্রাক্তন ফুটবলার, তার টাটা ফুটবল এ্যকাডেমির অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাচ্ছেন। এত সফল্যের পরেও শরীরের ভাষায় কোনও বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই। সর্বত্র যেন--একে অন্যে তরে। এই শৃঙ্খলা ও সংযমটাই বাংলার ফুটবল থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
মহামেডান স্পোর্টিং কলকাতা লিগ, ডুরান্ড কাপ ও আইলিগ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৩টা ম্যাচ খেলে ৪০টা ম্যাচে অপরাজিত থেকেছে। আইলিগে তারা নিজেদেরই টানা ১১টা ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভাঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরের দিল্লি এফসির বিরুদ্ধে ম্যাচে অপরাজিত থাকলে,তারা টানা ১২টা ম্যাচ অপরাজিত থাকবে। আর ২টো গোল করলে মরশুমে ৪৪ ম্যাচে ১০০ গোল করার কৃতিত্ব অর্জন করবে। ম্যাচ প্রতি ২য়ের অধিক গোল। ২৫/২৬জনের স্কোয়াড একটা মরশুমে ৪০এর বেশি ম্যাচ খেললো। এখনো টিমটাকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছেনা। বর্তমানে সময়ে টোটাল টিমের এমন ফিট থাকাটাই সাফল্যের চাবিকাঠি। অপেশাদার কঠামোয় এমন নজির খুব কম থাকে। যেখানে টিমের গড়বয়স ২৬ পেরিয়ে যায়নি।
শ্রীনিধি ডেকান,গোকুলাম কেরল,রিয়েল কাশ্মীর ও ইন্টার কাশির মত একাধিক শক্তিশালী দল চ্যাম্পিয়ানশিপের জন্য গায়েগায়ে লড়াই করেছে।এছাড়া,চার্চিল ব্রার্দাসের বিরুদ্ধে ২টো ম্যাচই কঠিন ছিল। রিয়েল কাশ্মীর ছাড়া আইলিগের সব দলের বিরুদ্ধেই জয় এসেছে। দুরন্ত লড়াই হয়েছে। এই লড়াইয়ে ৩৯টা হলুদ কার্ড ও ৩টে লার্ড টিমের দেখতে হলেও, টিম মহামেডানের পার্সিং ফুটবল ছিল দৃষ্টিনন্দন। মাঝমাঠের সব প্লেয়ারাই আইলিগে গোল পেয়েছে। মাঝমাঠে কাশিমভ ও গোমসের সাথে আঙ্গুসানা,বিকাশ,ফানাই ও ডেভিডদের অসাধারণ লড়াই ছিল। গোল করা ও গোল করানোর ক্ষেত্রে কেউ স্বার্থপর হয়নি।গোমস, আঙ্গুসানা ও ফানাইরা গোল যেমন করেছে, তেমনি সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়েছে। খুব ইন্টারেস্টিং যে কোচ চের্নিশভ ডেভিডকে দারুণভাবে উইং,এ্যটাকিং মিডফিল্ডে ব্যবহার করেছেন।ডেভিড কলকাতা লিগে ২০টা গোল করেছিল।আইলিগে ওর ৫টা গোল আছে। বিদেশি এডি হার্নান্দেজ ১৩টা গোল করেছেন। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে লালরেনসাঙ্গা ফানাই উইং থেকে ডেভিডের মত ৫টা গোল করে গেছেন। কোচ কিন্ত বিকাশ,ফানাই ও ডেভিডকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দারুণ ব্যবহার করেছেন। ইষ্টবেঙ্গল থেকে আঙ্গুসানাকে মহামেডানে যোগ করানো মহামেডান কর্তারদের সফলতা বলা যায়। মহামেডান মাঝমাঠে কাশিমভ, গোমস ও আঙ্গুসানা যেন তেল দেওয়া মেসিন। ডিফেন্সে আদজেইর সাথে ইরশাদের জুটি সফল। সাইডব্যাকে সামাদ,জাসিম,রালতেরা যে যখন সুযোগ পেয়েছে, দারুনভাবে মানিয়ে নিয়েছিল।
প্রত্যেকেই তাদের সেরাটা দিয়েছে। এককথায় দলগত সংহতিতে জয় এসেছে। যাকে তারুণ্যের জয় আখ্যা দেওয়া যায়। মহামেডান স্পোটিং ক্লাবের এই সাফল্য তাই বিশেষ উল্লেখযোগ্য।মনে রাখা দরকার,ইষ্টবেঙ্গলের মত শক্তিশালী দলও কিন্তু আইলিগে দীর্ঘদিন খেলে চ্যাম্পিয়ান হতে পারেনি।
২০২৪/২৫ মরশুমে আইলিগের প্রথম বিভাগে বাংলার কোনো দল থাকবেনা। ফলে আইলিগ থেকে আইএসএলের প্রমোশনে বাংলার কোনো দল লড়াইয়ে থাকলোনা। এই মরশুমে আইলিগের দ্ধিতীয়বিভাগে ইউনাইটেড স্পোর্টসের লিগ টেবিলের যে অবস্হান, তাতে দ্ধিতীয় দল হিসেবে আইলিগের প্রথম বিভাগে ওঠার সম্ভাবনা আপাততঃ খাতায় কলমে থাকলেও, বাস্তবে প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে আছে।
দেশের সবোর্চ্চ লিগ অর্থাৎ আইএসএলে একমাত্র বাংলা থেকেই পরের মরশুমে ৩টে দল খেলবে।ভারতবর্ষের আর কোনো রাজ্য থেকে এমন প্রতিনিধিত্ব নেই। পরের মরশুমে আইলিগের প্রথম বিভাগে কোন দল না থাকলেও ২য় ও ৩য় বিভাগে বাংলার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সর্বভারতীয় স্তরে বাংলার দলগুলোর প্রাধান্য থাকলেই ভারতীয় ফুটবলে বাংলা ঘুরে দাড়াতে পারবে। অনেক সমলোচনা শুনেও আইএফএ কিন্তু মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রস্তুতিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আইএফএ কলকাতা প্রিমিয়ার লিগের চ্যাম্পিয়ানশিপের খেলা-- মহামেডানের আইলিগ ক্রীড়াসূচীকে মান্যতা দিয়েছে। এভাবেই আইএফএর এখন থেকেই সামনের মরশুমে যারা আইলিগের ৩য় বিভাগে খেলবে,তাদের সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা করা উচিত। আজ ব্যাঙ্গালরু ও গোয়ার দলগুলো যে সুযোগ পাচ্ছে,তা বাংলার দলগুলো পাবেনা কেন? আইলিগের ৩য় বিভাগের প্রাথমিক ও চুড়ান্তপর্বের খেলা বাংলায় হোক। এবছর ডুরান্ড কাপ,সুপার কাপ ও আইলিগে বাংলার দলগুলো চ্যাম্পিয়ান হলো। আইএসএলের লিগ-শিল্ড ও প্লে-অফের কাপ কিন্তু বাংলার দরজায় কড়া নাড়ছে। চরম মুহূর্তের সেই সাফল্য ছিনিয়ে আনাতে বাংলার অপর দুই বড়ক্লাব মহামেডান স্পোর্টিংয়ে সাফল্যে অনুপ্রাণিত হোক।