অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়ঃ সাংবাদিকদের মধ্যে একমাত্র জি সি দাস আমাকে ডাকনামে ডাকতেন। আসলে সেসময় শুধুই ল্যান্ডলাইন, প্রায়ই সকালে বাড়িতে ফোন করতেন। বাবা ফোন করে ডাক নামেই হাঁক দিত, আমি ফোন ধরলে দাসদা ওই নামেই সম্বোধন করতেন। পরবর্তীকালে ওটাই নিয়ম হয়ে যায়। খারাপ লাগত না, প্রায় বাবার বয়েসি একজন মানুষ। কিন্তু মিশতেন বন্ধুদের মতই। আজকালে ফ্রিল্যান্সিং শুরু হওয়ার আগে জি সি দাস তো আমাদের কাছে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য, দূরের উপগ্রহ, অন্য দুনিয়ার জানলা। ছাত্রজীবন, চুটিয়ে খেলা পড়ছি আর জীবন্ত বিস্ময়ের মত আসছে ওই নামটা, জি সি দাস।
লোকটা মারাদোনার সঙ্গে কথা বলে, পাওলো রোসি সোনার বুট পেয়ে কোন শোকেসে রাখবে বলে দেয়, গুলিট ঝাঁকড়া চুল কীভাবে ম্যানেজ করে সে খবরটাও তাঁর জানা। আমাদের কল্পনায় জি সি দাস তখন নিজেই সব পেয়েছির দেশ। যে সময়টার কথা বলছি, তখন তো আর মেসি বেডরুমে কীভাবে বিশ্বকাপ পাশে রেখে ঘুমোয়, তার সুযোগ ছিল না কিংবা আল নাসেরে রোনাল্ডো কেমন খেলছেন, সেটা জানারও সুযোগ নেই। সুযোগ একটাই, জি সি দাস কী লিখলেন।
১৯৯৪ বিশ্বকাপে আজকালে প্রথমবার লেখার সুযোগ হল। ডেস্কে কাজ, নিউজ সাবিং। ক্রীড়া সম্পাদক ধীমানদার মত প্যাশনেট মানুষ আমি অন্তত কর্মজীবনে খুব কম পেয়েছি। অনেকে অনেক কথা বলত শুনতাম, কিন্তু এমনি এমনি তো আজকাল ক্রীড়া বিভাগ দেশের সেরা ছিল না। খবরের জন্য মাটি কামড়ে পড়ে থাকা, নিয়মিত ফলোআপ, নিজের দায়িত্বের পাতাটাকে সেরা করার প্রবল করার পাগল করা নেশা- এসব সামনে থেকে দেখা। আর সেই প্যাশনটা থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত দাবি করতেন ধীমানদা।
আমেরিকার বিশ্বকাপ চলাকালীনই শুনছি, জি সি দাসকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আপনি এখনই ব্রাজিল ক্যাম্পে ঢুকে যান কিংবা পেলের সঙ্গে একবার কথা বলে রি অ্যাকশন নিন। উল্টোদিক থেকে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে জানার উপায় নেই। কিন্তু আমার কল্পনার জি সি দাস আরও একটু বড় হচ্ছেন, চকচকে হচ্ছেন, ধারালো হচ্ছেন। আমেরিকায় বিশ্বকাপ শেষ হলে তাঁকে প্রথম দেখলাম আর সব রোমান্টিসিজমের সেখানেই ইতি। আরে এত আমাদের ব্যাণ্ডেল বাজারের দাসকাকুর মত একটা লোক। নাম, গোবিন্দ চন্দ্র দাস। প্রদীপ কুমারের মত সরু একটা গোঁফ, ঢেউ খেলানো চুল, উত্তর কলকাতার বাংলায় কথা বলে, শ্যামবাজারে থাকে, অফিসে এলে আজকাল ক্যান্টিনের প্রভাতদার পোড়া চায়েই চুমুক দেয়। হাতে একটা বহু পুরোনো অ্যাটাচি, বিভিন্ন দেশের ফুটবল বিশ্বকাপের স্টিকার সাঁটানো। সেখান থেকে একটা করে লেখা বার করে ধীমানদাকে দিচ্ছেন। গোটা গোটা হরফে লেখা, সহজ বাংলা। ধীমানদার পছন্দ না হলে আমাদের মত কাউকে দিয়ে আবার লেখাচ্ছেন সেটাই। দাসদার ডিকোডিং হচ্ছিল একই সঙ্গে। ব্যবসাসূত্রে পশ্চিমের দেশগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর কারণে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা। সেভাবেই লেখার সুযোগ। আমাদের মত পেশাদার সাংবাদিক কোনদিনই ছিলেন না। কিন্তু সাংবাদিক হওয়ার কী প্রবল চেষ্টাটাই করে গেছেন সারাজীবন ধরে।
মনে আছে, বিশ্ব ফুটবলে কোন বড় খবর হলেই দাসদাকে গাড়ি পাঠিয়ে তুলে আনা হত আজকাল অফিসে। ধীমানদার যথারীতি অদ্ভুত অদ্ভুত দাবি থাকত। "মারাদোনা অ্যারেস্ট হয়েছে, আপনি একবার ক্লদিয়ার সঙ্গে কথা বলুন!" দাসদা কী করেন!! আর্জেন্টিনার কোন নম্বর ফোনে ধরে দুর্বোধ্য স্প্যানিশে কী সব বলে ধীমানদাকে বলতেন, "ধীমান, ক্লদিয়া ঘুমোচ্ছে।" ধীমানদার অবধারিত যুক্তি থাকত, "ঘুমোচ্ছে মানে! ঘুম থেকে তুলুন!" জি সি দাস আরও অসহায় মুখ করে কয়েকবার চেষ্টা করতেন। ফলাফল একই থাকত। কিন্তু অসাধারণ কিছু সুখস্মৃতি হয়ে এসব থেকে গেছে আমাদের মনের মনিকোঠায়।
১৯৯৮ বিশ্বকাপে দাসদা আজকাল রবিবাসরীয়তে নিজের লাইফের জার্ণিটা লিখলেন। ঘোস্ট রাইটার আমি। সেটাই বোধহয় দাসদার আজকালে শেষ লেখা। তারপর আর লিখেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু প্রতিদিনের সেই কথোপকথন, খুব কাছ থেকে অনেকটা সময় কাটানো, দাসদাকে দূরের পৃথিবীটা থেকে আমার পৃথিবীতে এনে দিয়েছিল। ব্যান্ডেলে আমার বি এস এ ক্লাবে ফুটবল ফাইনাল, দাসদা হাজির। যে লোকটা সাওপাওলো, রিভারপ্লেট, সানসিরো কিংবা ওয়েম্বলিতে ঘুরে বেড়ায়, সেই কিনা ব্যান্ডেলে!! এবং কোনরকম জাঁকজমক ছাড়াই। হাতে ওই পুরোনো অ্যাটাচি আর ক্রিম কালারের একটা জ্যাকেট!! ব্যাস। অনেকবছর দেখা হয়নি। মাঝে কয়েকবার ফোন করেছিলেন। গলার আওয়াজ আর ডাকনামটা শুনলেই বুঝতে পারতাম, দাসদা। আমাদের কৈশোরের পশ্চিমের জানলা। আমাদের ফ্যান্টাসির 'সঞ্জয়', যিনি ধারাভাষ্য দিয়ে গেছেন বহু মহারণভূমির।
আজ সকালে খবর পেলাম জি সি দাস তাঁর পশ্চিমের জানলা বন্ধ করে নিজেই অস্তাচলে গেলেন। ৮০ বছর কিংসাইজ বাঁচা। কোন বিতর্ক নেই, কারও ক্ষতি করার চেষ্টা নেই, পিঠ ঘোরালে কারও সমলোচনা নেই, শুধু নির্ভেজাল আনন্দ আছে। কখনও তিনি আন্তর্জাতিক জি সি দাস, কখনও তিনি শ্যামবাজারের গোবিন্দ চন্দ্র দাস।
হ্যাপি জার্ণি দাসদা। আবার নতুন কোন জাহাজের সওয়ারি আপনি। নতুন ভেন্যুতে প্রিয় সবাইকে পাবেন।পেলে, মারাদোনা, পুসকাস, জর্জ বেস্ট সবাই। আর কী চাই!